Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: দুর্গম ভারত (পর্ব ৬)

পঞ্চম পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: পৃথিবীর শেষ প্রান্তে

বিগত তিন বছর ধরে আলেকজান্ডার যাদের সাথে যুদ্ধ করছেন, তাদেরকে তিনি বর্বর বলেই মনে করেন। এখন তিনি এমন কাউকে হারাতে চান, যারা সভ্য। সভ্য আর বর্বর, এই দুই বিশেষণ একেকজন একেকভাবে ব্যবহার করে, তবে আলেকজান্ডার এবং তার মেসিডন বাহিনী সভ্য বলতে এমন কাউকে বোঝেন, যারা একই জায়গায় বহুদিন ধরে বসবাস করেছে, শহর এবং নগর গড়ে তুলেছে এবং নিজস্ব সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সভ্যতার এই সংজ্ঞা গ্রিস থেকেই এসেছে, অ্যাথেন্সের নগর-কেন্দ্রিক সভ্যতা আর এর নাগরিককেই সভ্যতার মানদণ্ড বলে মনে করেন আলেকজান্ডার। আর এরকমই একটি হলো ভারত।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬-এর শুরু। আলেকজান্ডার তার বাহিনী নিয়ে ভারতে প্রবেশ করলেন (বর্তমান পাকিস্তান)। পাথুরে জায়গা থেকে নেমেই আলেকজান্ডার ইন্দু নদীর তীরের বিশাল তৃণভূমির সামনে নিজেকে খুঁজে পেলেন। হেফাস্টিওন সামনে এগিয়ে আগে থেকেই এই বিশাল নদী পার হওয়ার জন্য নৌকার সেতু বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। মে এর কোনো এক দিন আলেকজান্ডার আর তার বাহিনী এই অজানা গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

কিছু দূর পার হতেই আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন এই ইন্দু আর অন্য পাঁচ-দশটা সাধারণ নদীর মতো নয়। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর চেয়েও এর প্রবাহের গতি অনেক বেশি, এমনকি এর উৎসস্থলও নীলের মতো অজানা (নীলের উৎপত্তিস্থল আবিষ্কৃত হয় ১৮৭২ সালে, ইন্দু নদীর ক্ষেত্রে তা আরো পরে, ১৯০৭ সালে)। নদীর আশেপাশের জায়গায় কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয়রা বাস করছে। আলেকজান্ডার প্রথমে সন্দেহ পোষণ করলেও আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব থেকে এখানে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ পর্যন্ত বসতি থাকার প্রমাণ মেলে।

আলেকজান্ডারের অপেক্ষায় ভারতীয়দের হাতিবাহিনী; Image Source: Indiafacts

ইন্দু নদী পার হওয়ার সময়েই মেসিডন বাহিনীর মধ্যে আবারো বিরক্তিভাব দেখা যেতে শুরু করে। হিন্দুকুশ পর্বত কিংবা সাহারা মরুভূমি, সবকিছুর চেয়ে এই ইন্দু নদীই তাদের কাছে বেশি ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিলো। দীর্ঘদিনের ক্লান্তিকর যাত্রাপথও এর অন্যতম কারণ। নদী পার হয়ে আলেকজান্ডার তার বাহিনী নিয়ে আরো ৬০ মাইল এগিয়ে এলেন। রাভি, বিয়াস, ঝিলাম আর চেনাব নদী একত্র হয়ে পাঁচ নদীর মিলনস্থল পাঞ্জাবে পৌঁছে গেলেন আলেকজান্ডার, যদিও তিনি জানতেন না, নদীগুলোর মিলনস্থল কোথায়। ঝিলাম নদীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি স্কাউটদের কাছে খবর পেলেন, নদীর পূর্ব পাশে এক বিশাল ভারতীয় বাহিনী জড়ো হয়েছে তাদের থামানোর জন্য।

পাঞ্জাবের রাজা পুরু আলেকজান্ডারের সৈন্যদের সমান সংখ্যাক সৈন্য নিয়েই হাজির হয়েছেন, সাথে রয়েছে বেশ কিছু হাতি। হাতির ওপর বসে থাকা তীরন্দাজরা মুহূর্তের মধ্যেই তীরের বৃষ্টি নামিয়ে আনতে সক্ষম। এখানে এসেই আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন, বর্বর লোকের চেয়ে সভ্য একত্র বাহিনী কত ভয়ঙ্কর।

রণপ্রান্তরে পুরুর বিপরীতে আলেকজান্ডার; Artist: Charles Le brun

সারাদিন ধরে ঝিলামের যুদ্ধ চলতে থাকল। আলেকজান্ডার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তার বেশিরভাগ সৈন্যই নদীর এপারে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, কিন্তু পুরুর বাহিনীর একাগ্রতা তাকে আট বছর আগের টায়ার অবরোধের কথা মনে করিয়ে দিল। যদিও ভারতীয় বাহিনী মেসিডনের তুলনায় বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তারপরেও তারা নিজেদের ধৈর্য আর একাগ্রতা ধরে রাখতে পেরেছিল। হাতিগুলোও মেসিডোনিয়ানদের অনেক ঘোড়াকে পায়ের নিচে ফেলে পিষ্ট করেছিল। অবশেষে ভারতীয় বাহিনী হাল ছাড়লো, পুরুকেও ধরে নিয়ে আসা হলো আলেকজান্ডারের সামনে।

আলেকজান্ডারের কাছে পুরুর আত্মসমর্পণ; Image Credit: Alonzo Chappel

ক্ষত-বিক্ষত পুরুকে দেখে আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কেমন ব্যবহার চান। পুরুর জবাব ছিল, “একজন রাজার মতোই”। পুরু যুদ্ধের আগে আলেকজান্ডার সম্পর্কে জানতেন কি না, তা জানা যায়নি, তবে তার উত্তর আলেকজান্ডারের পছন্দ হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই পুরু আলেকজান্ডারের বন্ধু ও সহযোগী হয়ে উঠলো। আলেকজান্ডারের সৌভাগ্য বলতেই হবে, কারণ কয়েকদিন আগেই তিনি তার প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছেন। ঝিলামের যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই বৃদ্ধ বুকেফ্যালাস তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।

বুকেফ্যালাসের বয়স প্রায় ৩০ হয়ে গিয়েছিল এবং শেষবার তাকে আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন গগামেলার প্রান্তরে। আলেকজান্ডার সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবেই সব জায়গায় বুকেফ্যালাসকে নিয়ে যেতেন। বুকেফ্যালাসের মৃত্যুর পর আলেকজান্ডার ঝিলাম নদীর দু’পাশে দু’টি শহর নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেন। একটি বুকেফ্যালাসের নামে, আরেকটি বিজয়ের চিহ্নস্বরূপ ‘ভিক্টরি’ নামে। বর্তমানে ঝিলাম নদীর দু’পাশের অনেকগুলো শহর আর গ্রামই দাবি করে, তাদের ওখানেই বুকেফ্যালাসকে কবর দেওয়া হয়েছে। আর এভাবেই বুকেফ্যালাস হয়ে উঠল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোড়া।

পুরুর সহায়তায় আলেকজান্ডার আরো পূর্বদিকে যাওয়া শুরু করলেন। আলেকজান্ডারের ইচ্ছা পুরো ভারত নিজের দখলে আনা। তার কাছে মনে হলো আমুনের পুরোহিত পৃথিবীর শেষ মাথা বলতে ভারতের শেষ মাথাকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ঝামেলা শুরু হলো। রাভি নদীর কাছে পৌঁছাতেই মেসিডোনিয়ানরা অস্বীকৃতি জানালো, তারা আর সামনে যাবে না। সেনাপতিরা বুঝতে পারল, আলেকজান্ডারের সামনে এবার মনের কথাগুলো খুলে বলার মতো অবস্থা এসেছে।

বিয়াস নদী পার হচ্ছেন আলেকজান্ডার; Image Source: worldhistory.us

আলেকজান্ডার সৈন্যদের উদ্দেশে বেশ বড়সড় একটা বক্তৃতা দিলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে এবারও সৈন্যরা তার বক্তৃতা শুনে আবারো অভিযানে শামিল হবে, অন্তত বছরের পর বছর তা-ই হয়ে এসেছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,

“হারকিউলিস যদি ১২টা শ্রমের বদলে পাঁচটা শ্রমের কাজ করেই থেমে যেতেন, তবে কি কেউ তাকে মনে রাখতো? আমরাও যদি আবারো অভিযানে নেমে পড়ি, আমাদের সম্মানও আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে।“

সৈন্যদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। আলেকজান্ডার চিৎকার করে বললেন, “জবাব দেওয়ার মতো কি কেউ আছে?” অবশেষে কোয়েনাস সামনে এগিয়ে এলেন, যিনি মেসিডোনিয়া থেকে এ পর্যন্ত অনেকগুলো যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সাধারণ সৈন্যদের পক্ষ থেকে আমি কিছু বলতে চাই,

এখানে যারা উপস্থিত আছে, তারা সবাই নিজেদের বাবা-মাকে আরো একবার দেখতে চায়, যদি তারা এতদিন বেঁচে থাকে। কিংবা স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের জন্য, সবাই একবার নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চায়। গরীব হিসেবে নয়, বরং যুদ্ধে জেতার পর আপনার দেওয়া এই সম্পদ থেকে। এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যাতে তারা আর আগ্রহী নয়। যদি তারা এতে নিজেদের হৃদয় না দিয়ে থাকে, সেই পুরনো স্পৃহা বা সাহস, কোনোটাই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না… স্যার, একজন সফল মানুষের জানতে হয়, কখন থামা উচিত। মনে হয় না, আপনার মতো সেনাপতি, যার আমাদের মতো একটা সেনাবাহিনী আছে, পৃথিবীর আর কোনো শত্রুর ভয় পাবে না। কিন্তু ভাগ্য, যেকোনো সময় আপনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে, এবং তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ করাও সম্ভব নয়।

কোয়েনাসের জবাবের পর মাঠ থেকে সমস্বরে হর্ষধ্বনি ভেসে আসলো। সৈন্যরা জানান দিল, তারা যা বলতে ভয় পাচ্ছিলো, কোয়েনাস ঠিক সেগুলোই বলেছেন। আলেকজান্ডার রেগে সবাইকে বললেন,

“যারা যেতে চায়, তারা যাও। তাদেরকে আমি মুক্ত করে দিলাম। কিন্তু যারা থাকতে চাও, তারা থেকে যাও।”

অগ্নিশর্মা আলেকজান্ডার এরপর তিনদিন নিজের তাঁবু থেকে বের হননি। ভেবেছিলেন, এটি দেখে কেউ হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে। কিন্তু কেউই শেষমেষ আর তার কাছে আসেনি। আলেকজান্ডার শেষমেশ হারলেন, সৈন্যদের মাতৃভূমি দেখার আকাঙ্ক্ষার কাছে।

তিনদিন পর আলেকজান্ডার তাঁবু থেকে বের হলেন। পুরোহিতদের কাছে জানতে চাইলেন, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। পুরোহিতদের নেতিবাচক জবাবে অবশেষে আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ায় ফিরতে সম্মতি দিলেন। সৈন্যদের তাঁবুতে চিৎকারের রোল পড়ে গেল। আলেকজান্ডার সবকিছুই জিতেছেন, তার সৈন্যদের ধৈর্য ছাড়া।

সপ্তম পর্ব: দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার: বিপদশঙ্কুল যাত্রা

Related Articles