Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারত-পাকিস্তান নৌযুদ্ধ (পর্ব-১): অপারেশন দ্বারকা

১৯৬৫ সাল। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমে সীমান্ত সংঘর্ষ এবং পরে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিতীয় ইন্দো-পাক যুদ্ধে শুরুতে পাকিস্তানের ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ ও ‘অপারেশন গ্র্যান্ডস্লাম’ নামে দুটি অভিযান ব্যর্থ হয়।

কাশ্মির ও পাঞ্জাব সীমান্তে ভারতীয় বিমানবাহিনী যেন শক্তি কমাতে বাধ্য হয় সেজন্য পাকিস্তান নৌবাহিনী ১৯৬৫ সালের ৭-৮ সেপ্টেম্বর ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে পরিচালনা করে অপারেশন দ্বারকা নামক ‘হিট এন্ড রান’ অপারেশন। তবে এ ধরনের আচমকা হামলা সাধারণত শত্রুর শক্তিশালী নৌঘাঁটিতে করা হয় যেন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা সম্ভব হয়। কিন্তু গুজরাটের দ্বারকা ঘাঁটি সেরকম কিছু নয়। কিন্তু কেন সেকেন্ডারি টার্গেট বেছে নিয়েছিল পাকিস্তানি এডমিরালরা?

এই অপারেশনের বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের। সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা হলো:

১) ভারতের গুজরাট প্রদেশের উপকূলবর্তী ছোট্ট শহর দ্বারকা। এখান থেকে করাচি বন্দরের দূরত্ব প্রায় ২০০ কি.মি। দূরত্বের স্বল্পতার কারণে এক রাতের মধ্যেই আক্রমণ করে নিরাপদে ফিরে যাওয়া সম্ভব।

২) অন্যান্য ভারতীয় নৌঘাঁটির তুলনায় দ্বারকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলনামূলক দুর্বল ছিল।

৩) ঐতিহাসিকভাবে এই শহরে হামলা করাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবতা শ্রীকৃষ্ণের শহর ছাড়াও ঐতিহাসিক মন্দিরসহ নানা স্থাপনার কারণে দ্বারকা বিখ্যাত ছিল। পাকিস্তানের ধারণা ছিল আচমকা হামলায় ঐতিহাসিক শহরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে তারা ভারতীয়দের মনোবল নষ্ট করে দিতে পারবে।

ম্যাপে করাচি, দ্বারকা ও মুম্বাই এবং ১৫ শতকে নির্মিত দ্বারকাদিশ মন্দির; Image Courtesy: Edited by Author

৪) সামরিকভাবেও দ্বারকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। এখানে থাকা ভারতীয় রাডার স্টেশন ধ্বংস করে দিতে পারলে তাদের বোমারু বিমানগুলোকে গাইড করে সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পাকিস্তানে হামলা করাটা কঠিন হয়ে যাবে। একইসঙ্গে ভারতীয় নজরদারি এড়িয়ে হামলা করতে পারবে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান।

৫) হামলার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল মুম্বাই নৌঘাঁটি থেকে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ বের করে আনা। পাকিস্তানি এডমিরালদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে দ্বারকায় হামলার খবর পেয়ে পলায়নরত পাকিস্তানিদের ধাওয়া করতে আসবে ভারতীয়রা। তাদেরকে পিএনএস গাজীর পাতা ফাঁদে ফেলে আরো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে। তৎকালীন শক্তিশালী পাকিস্তানি এই সাবমেরিনকে ভারতীয়রা বেশ সমীহ করতো।

তৎকালীন শক্তিশালী সাবমেরিন ছিল পিএনএস গাজী; Image source : wikipedia.org

৬) এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় যুদ্ধবিমান কাশ্মীর থেকে দূরে সরিয়ে আনা। কেননা দ্বারকায় পুনরায় হামলা হলে প্রতিরোধ করার জন্য বাড়তি বিমান আনতে হলে সেখান থেকেই আনতে হবে। ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো তখন কাশ্মীর যুদ্ধে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। নৌবাহিনীর কারণে কাশ্মীরে বিমান শক্তি কমালে লাভবান হবে পাকিস্তান আর্মি- এই প্রত্যাশায় অপারেশন দ্বারকা অনুমোদন করে পাকিস্তান সরকার।

এসব কারণে ১৯৬৫ সালের দ্বিতীয় ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধে অপারেশন দ্বারকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৬৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পাকিস্তানি নৌবাহিনী করাচি থেকে যাত্রা শুরু করে। পিএনএস বাবর, খাইবার, বদর, জাহাঙ্গীর, আলমগীর, শাহ জাহান ও টিপু সুলতান নামের ৭টি যুদ্ধজাহাজ এই অপারেশনে অংশ নেয়। সাবমেরিন পিএনএস গাজী ও মাঝ সাগরে রিফুয়েলিংয়ের জন্য তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজ পিএনএস ঢাকা। জাহাজগুলো ভারতীয় নৌবাহিনীর চোখ এড়িয়ে গুজরাট উপকূলে পৌঁছে যায়। 

ভারতের দ্বারকা নৌ ঘাঁটি ও পাকিস্তানের পিএনএস বাবর; Image source : wikipedia.org

হামলা ও ক্ষয়ক্ষতি

রাত ১১:৫৫, ঘুমে আচ্ছন্ন দ্বারকা শহরের অধিবাসীরা বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে জেগে উঠল। পিএনএস বাবরের দেখানো পথ ধরে একের পর এক গোলাবর্ষণ শুরু করে বাকি যুদ্ধজাহাজগুলো। পাকিস্তানিরা একটানা ২০ মিনিট ধরে দ্বারকায় গোলাবর্ষণ করে। নেভাল আর্টিলারির মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে ওঠে আরব সাগর।

প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ থেকে ৫০টির বেশি শেল নিক্ষেপ করা হয়। রাডার স্টেশন ও বিমান ঘাঁটির রানওয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি রেলওয়ে ইঞ্জিন, রেলওয়ে গেস্ট হাউস ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সোমনাথ মন্দির ও রেডিও স্টেশনের মতো বেসামরিক টার্গেটেও কামান দাগানো হয়। এসব জায়গার নরম মাটিতে ৪টি শেল বিস্ফোরিত হতে ব্যর্থ হয়। সব মিলিয়ে মোট ৪০টির মতো অবিস্ফোরিত গোলা পাওয়া যায়। এসব গোলার গায়ে ‘ইন্ডিয়ান অর্ডিন্যান্স, ১৯৪০‘ লেখা ছিল। অর্থাৎ পাকিস্তান দেশভাগের সময় প্রাপ্ত পুরোনো শেল ফায়ার করায় এগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। এসব কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আশানুরূপ হয়নি।

তবে যুদ্ধে একপক্ষ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে বলবে আরেকপক্ষ কমিয়ে বলবে- এটাই চিরন্তন সত্য। অপারেশন দ্বারকা নিয়ে ভারতীয় ও পাকিস্তানি উৎসগুলো পরস্পরবিরোধী কথা বলে থাকে। রেডিও পাকিস্তান দাবি করেছিল যে দ্বারকা সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। স্থলভাগ থেকে ২০ কি.মি দূরে থাকা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজগুলো পরিস্কারভাবে আগুন ও ধোঁয়া দেখতে পেয়েছে।

বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বটে, তবে এত বেশি নয়। দ্বারকার রাডার স্টেশনে হামলা হলেও সেটি কিছুদিনের মধ্যেই আবার অপারেশনাল হয়। গুজরাটের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে স্বয়ং তাদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা তার মন্দিরসহ দ্বারকাকে রক্ষা করেছেন। এই হামলায় মোট ৪৯ জন সামরিক-বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। পাকিস্তানি নৌবহর বিনা বাধায় বোম্বিং করার নিরাপদে করাচি ফিরে যায়। তারা ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনীর তরফ থেকে পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছিল। কিন্তু বাস্তবে তার কোনোটিই ঘটেনি।

পাকিস্তানিরা কল্পনাও করেনি যে ভারতীয়রা এই হামলার জবাবে কিছুই করবে না। ফলে তাদের অপারেশন আংশিক সফল হলেও তারা সন্তুষ্ট ছিল না। কারণ কাশ্মীর থেকে বিমান সরায়নি ভারতীয় হাই কমান্ড। রাডার স্টেশন সম্পূর্ণ ধ্বংস না হওয়ায় করাচিতে আবারও বিমান হামলার আশঙ্কা থেকেই গেল। মূলত ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎকালীন দুর্বলতা ও সাবমেরিন গাজীর পাতা ফাঁদের বিষয়টি টের পেয়ে মার খেয়ে চুপচাপ ছিল তারা।

অপারেশন দ্বারকা পাক-ভারত যুদ্ধে প্রথম নৌ অপারেশন; Image source : thefrontierpost.com

প্রতিক্রিয়া

দ্বারকায় হামলার জবাব না দেয়ায় ভারতীয় নৌবাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হামলার সময় আইএনএস তলোয়ার নামে একটি যুদ্ধজাহাজ নিকটস্থ ওখা বন্দরে ইঞ্জিনের মেরামত কাজ করছিল। ঐ মুহূর্তে হামলার খবর পেয়ে সেটি পাকিস্তানিদের পশ্চাদ্ধাবনে যেতে চাইলেও তাকে অনুমতি দেয়নি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তাকে পরদিন সকালে দ্বারকায় উদ্ধার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমন নয় যে ঐ সময়ে ভারতের পাল্টা আক্রমণ করার সামর্থ্য ছিল না। প্রকৃত ঘটনা হলো ঐ মুহূর্তে ১০টি শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের কোনো না কোনো আপগ্রেড এবং রিপেয়ারিংয়ের কাজ চলছিল। এছাড়া পিএনএস গাজীর সমকক্ষ রণতরী ভারতের ছিল না। তাই ভারত স্থলযুদ্ধে অধিক আগ্রহী ছিল। তারা পাল্টা জবাব না দিয়ে কাশ্মীরে শক্তি বৃদ্ধি করে।ফলে পাকিস্তান সফল আক্রমণ করেও সুবিধা করতে পারেনি। কারণ ভারত যে এই আক্রমণের জবাব দেবে না সেটা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারেনি। একতরফা আক্রমণ সত্ত্বেও অপারেশন দ্বারকা পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য অনেক বড় অর্জন। এই অভিযানকে স্মরণীয় করে রাখতে পাকিস্তান এখনও ৮ই সেপ্টেম্বর ‘নৌবাহিনী দিবস’ হিসেবে উদযাপন করে।

৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ছবিতে দ্বারকা হামলার যুদ্ধজাহাজগুলোর কমান্ডারগণ; Image source : ranker.com

অপরদিকে ভারত তাদের দুর্বল নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। এক ধাক্কায় ভারতীয় নৌবাহিনীর বাজেট ৩৫০ মিলিয়ন রূপি থেকে ১.৫ বিলিয়ন রূপিতে বেড়ে দাঁড়ায়। যার ফলে পরবর্তী ছয় বছরে ভারত নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। এর ফলাফল পায় ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানি শীর্ষ নেতৃত্ব আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে বিশ্বের কাছে দেখানোর জন্য ভারতকে বোকার মতো আক্রমণ করে বসে। তাদের পাল্টা হামলায় দ্বারকা অপারেশনে অংশ নেয়া যুদ্ধজাহাজ পিএনএস গাজী, পিএনএস খাইবার, পিএনএস শাহজাহান ও পিএনএস ঢাকা ধ্বংস হয়। এর পর শুরু হয় ভারতের অপারেশন ট্রাইডেন্ট যাকে মূলত দ্বারকা হামলার কপি-পেস্ট ও প্রতিশোধমূলক অপারেশন বলা যায়।

এই সিরিজের অন্যান্য পর্ব

Related Articles