Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাচিকো: পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল যে মেয়েটি (পর্ব – ৬)

মিজু

আগস্ট ৯-১১, ১৯৪৫

বোমা বিষ্ফোরণের ফলে সাকামোতো সিমেট্রির জায়গায় জায়গায় সমাধিফলক উঠে এসেছিলো। ফলে বিভিন্ন জায়গাতেই বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছিল।

এমনই একটি গর্তে মায়ের সাথে গাদাগাদি করে বসলো সাচিকো। এককালের ধূসররঙা পাথরগুলো আগুনের উত্তাপে পুড়ে কমলা বর্ণ ধারণ করেছিল। পাশেই তখনও ধিকিধিকি করে আগুন জ্বলছিলো।

দুর্বল গলায় আশেপাশে থেকে কেউ বলে উঠলো, “মিজু, মিজু (পানি, পানি)।”

সাচিকোরও পিপাসা পেয়েছিলো। অনেক পিপাসা। কিন্তু আশেপাশে পানির কোনো উৎসই ছিলো না।

সাকামোতো সিমেট্রি; Image Source: Wikimedia Commons

সাচিকো মায়ের আরো কাছে চলে আসলো। ওদিকে মা’র কোলে তখনও ছিলো চিরতরে ঘুমিয়ে পড়া তোশি। হঠাৎ করেই এক শীতল শিহরণ বয়ে গেলো সাচিকোর ভেতর দিয়ে। উষ্ণতার জন্য সে মায়ের গায়ে গা ঘেষে রইলো।

বৃষ্টি নেমে এলো।

ফোঁটাগুলো একেবারেই স্বাভাবিকের মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিলো না। বরং সেগুলো ছিলো কালো ও তেল চিটচিটে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সাচিকোর জামা-কাপড়সহ পুরো শরীর ভিজিয়ে দিলো। সে চেষ্টা করছিলো তেল চিটচিটে এই বৃষ্টির ফোটাগুলো যেন তার গায়ে না লাগে, কিন্তু সেগুলো তাকে ঠিকই ভিজিয়ে দিচ্ছিলো।

আরো অনেক সময় চলে গেলো। বি-২৯ বোমারু বিমানগুলো মাথার উপর তখনও গর্জন করে যাচ্ছিলো। আগুনের লেলিহান শিখা তখনও তার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছিলো। পাহাড়ের বুক থেকে ভেসে আসছিলো আহতদের আর্তনাদ।

বাবা আর মামা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদের পক্ষে কবরস্থানে থাকাটা একেবারেই ঠিক হবে না। সবারই পানি আর খাবার দরকার। তাদের অবশ্যই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু সাচিকো খাবারের কথাও ভাবতে পারছিলো না। আগুন, ধোঁয়া আর আতঙ্ক তার ক্ষুধার অনুভূতিও কেড়ে নিয়েছিল।

বি-২৯; Image Source: Roadkill

একসময় ভোরের আলো ফুটলো। বোমারু বিমানগুলো হুট করেই উধাও হয়ে গেলো। আকাশ একেবারে নীরব হয়ে গেলো। মাছির ভনভন শব্দই কেবল শোনা যাচ্ছিলো।

আস্তে আস্তে ভনভন শব্দ বৃদ্ধি পেলো। চারদিকে কেবল মাছি আর মাছি!

… … … …

সন্ধ্যা নাগাদ বাবা আর মামা মিলে শিমাবারায় ফিরে যাবার পরিকল্পনা করলেন।

লোকমুখে বাবা শুনেছিলেন, উদ্ধারকারী ট্রেন নাকি মিচিনূ স্টেশনে এসে আহতদেরকে শহর থেকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি সাচিকোরা সপরিবারে শিমাবারা ফিরে যায়, তাহলে তারাও সাহায্য পেতে পারে।

মা মাটিতে বসে ছিলেন। তখনও কোলে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিলেন তোশির নিথর দেহটি।

না”, বলে প্রবলবেগে মাথা নাড়ালেন মা। তোশিকে এখানে রেখে কিছুতেই যেতে চাইলেন না তিনি।

মায়ের দিকে তাকালেন বাবা। অবশ্যই তারা তোশিকে কবর দিয়ে এরপরেই যাবে। সেই সাথে কবর দেয়া হবে সাচিকোর বন্ধুদেরও। মামাও বাবার কথার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে মাথা নাড়ালেন। এরপর সাচিকোর বন্ধুদের মৃতদেহগুলো আনতে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন তিনি।

বাবা, মা, সাচিকো, আকি, ইচিরো আর মিসা মিলে টাইলসের ভাঙা টুকরা দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে দিলো। সাচিকোও সর্বশক্তি দিয়ে মাটি খুঁড়ছিলো, আর একটু পর পর মাছি তাড়াচ্ছিলো।

মামা ফিরে আসলেন। চারটি মৃতদেহ আনতে তাকে বেশ কষ্টই করতে হয়েছিলো। মা তোশিকে শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

আমাকে ক্ষমা করে দিও”, ফিসফিসিয়ে এটুকু বলেই নিজ সন্তানকে একটু আগেই খনন করা অগভীর গর্তে শুইয়ে দিলেন তিনি। “আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না”, এটুকু বলে তিনি তোশির হাত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রাখলেন।

তোশি মারা গেছে? সাচিকো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে, সে আর কখনোই তোশির হাততালির শব্দ শুনতে কিংবা হাসিমাখা মুখ দেখতে পাবে না।

বাবা একমুঠো মাটি হাতে তুলে নিলেন।

থামো, আমি আর সহ্য করতে পারছি না”, বলেই কেঁদে উঠলেন মা। দাঁত দিয়ে নিজের কিমোনোর একটা অংশ ছিড়ে নিয়ে সেই অংশটি নিজের আঙুলে পেচিয়ে নিলেন তিনি। এরপর সযত্নে তোশির চোখ আর নাকে লেগে থাকা ময়লা পরিষ্কার করে দিলেন। সবার শেষে সেই কাপড়ের টুকরোটি দিয়ে তোশির মাথা ঢেকে দিলেন।

অন্তত তার এই সুন্দর মুখটাকে মাটি স্পর্শ করতে পারবে না”, বললেন মা। কবর দেয়া শেষ হলে তোশির কবরের উপর মা চিহ্ন হিসেবে একটি পাথর রেখে আসলেন।

… … … …

দিন পেরিয়ে সন্ধ্যায় নামলো। একসময় নেমে এলো রাতের নিস্তব্ধতা। পুরোটা রাত সেই গর্তে বসেই কাটিয়ে দিলো সাচিকো। গলা শুকিয়ে এসেছিলো তার, ফেটে গিয়েছিল ঠোঁট, আশেপাশে থেকে ভেসে আসছিলো তৃষ্ণার্তদের হাহাকার।

মিজু, কুদাসাই (দয়া করে পানি দাও)।”

মেয়ের দিকে ঝুঁকে তার কাঁধ ধরে বাবা কথা বলতে শুরু করলেন, “সাচিকো, যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে মা। আমার পেছন পেছন আসো। মনে রেখ, ভুলেও আমার চোখের আড়াল হবে না। বুঝতে পেরেছ?

সাচিকো মায়ের হাত ধরে রইলো। মিসা ছিলো মায়ের পিঠে। আকি হাঁটছিলো বাবার সাথে। আর ইচিরো হাঁটছিলো মামার পেছনে পেছনে। স্টেশনটা ছিলো প্রায় ৩ মাইল (৪.৮ কিলোমিটার) দূরে।

মিচিনূ স্টেশন (২০০৯); Image Source: Wikimedia Commons

সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ইচিরোর বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। ওর বমি থামছিলোই না। বাবা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এগিয়ে নিতে থাকলেন। আকি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলো। তার কাঁধের অনেকখানি পুড়ে গিয়েছিলো। ফলে হাঁটাচলা করাটা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বাবা নিচু হয়ে বড় ছেলেকে নিজের পিঠে তুলে নিলেন।

মায়ের উষ্ণ আঙ্গুলগুলোকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সাচিকো। ওদিকে বাবার পিছু পিছু মা এক পা, দু’পা ফেলে মোহাবিষ্টের মতো হাঁটছিলেন।

আশেপাশের সবকিছুই পুড়ে, গলে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল। কলকারখানা, বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, মঠ, মন্দির- কিছুই বাকি ছিলো না। টেলিফোনের তারগুলো অন্ধকারে নিচু হয়ে ঝুলে ছিল। জায়গায় জায়গায় পড়ে ছিলো শিকড় উপড়ানো অজস্র হতভাগা গাছ। দূর থেকে শিকড়গুলোকে ঝাঁটার বাটের মতো মনে হচ্ছিলো।

এক পা, দু’পা করে উষ্ণ ছাইয়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সাচিকো। এক হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে রেখেছিলো সে, যাতে নিঃশ্বাসের সাথে ছাই না চলে আসে। আগুন তখনও জ্বলছিলো। পোড়া মানবদেহের গন্ধে পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠেছিলো। আগুনে ঘোড়াগুলো পুড়ে কয়লার মতো হয়ে গিয়েছিলো। রাস্তায় মানুষেরা পাথরের ন্যায় পড়ে ছিলো; কেউ জীবিত, কেউ বা মৃত।

বোমা হামলায় আহত মা-মেয়ে (আগস্ট ১০, ১৯৪৫); Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

এমন উত্তপ্ত জায়গার উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সাচিকোর পা খানিকটা পুড়েই গেলো। বাবা নিচু হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা কিমোনো, শার্ট, প্যান্টের ছেঁড়া অংশগুলো কুড়োতে লাগলেন। এরপর এক জায়গায় থেমে আকিকে পিঠ থেকে নামালেন। এবার সাচিকোর সামনে গিয়ে খুব সাবধানে তার ছোট্ট দুই পায়ে কাপড়গুলো বেঁধে দিলেন।

এগোতে এগোতে আরো অনেকের কথাবার্তাই কানে আসলো সাচিকোর।

মিজু, কুদাসাই (দয়া করে পানি দাও)।”

কেউ কেউ কাতর স্বরে বলে উঠলো, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মেরে ফেলো, আমাকে মেরে ফেলো।

হঠাৎ করেই হোঁচট খেলো সাচিকো। খুব শক্ত কিছু একটার সাথেই ধাক্কা লেগেছে তার। নিচে তাকিয়ে দেখতে পেলো দুটি মৃতদেহ; মা আর সন্তান, একেবারে পুড়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে সে আর এগোতে পারলো না।

সাচিকো!”, বাবার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলো সে। “সাচিকো, কিচ্ছু চিন্তা করা যাবে না। কিচ্ছু না। শুধু আমার পিছু পিছু আসো।

একের পর এক মৃতদেহ পেরিয়ে যেতে থাকলো সাচিকো। অগ্রাহ্য করে গেলো অনেকের বাড়িয়ে দেয়া হাতও। কেউ কেউ কেবল ফিসফিসিয়ে বলছিলো, “পানি, পানি, পানি।

আত্মীয়স্বজন ও ঘরবাড়িই খুঁজছিলো সর্বহারা এ মানুষগুলো; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য উঠে গিয়েছিল। সেখানে ভিড় জমিয়েছিল তাদের মতো আরো অনেকেই। নিজের ভাই-বোনদের বাদে জীবিত আর কোনো শিশুকেই দেখতে পায়নি সাচিকো।

তার জন্য তো আকি, ইচিরো আর মিসা ছিলো! ছিলো বাবা, মা এবং মামাও! প্লাটফর্মে সবাই একসাথে অপেক্ষা করতে লাগলো। তীব্র পানি পিপাসায় তাদের সকলের প্রাণই তখন ওষ্ঠাগত।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) পর্ব – ১

২) পর্ব – ২

৩) পর্ব – ৩

৪) পর্ব – ৪

৫) পর্ব – ৫

This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.

Reference Book

1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Feature Image: History Net

Related Articles