Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক রোহিঙ্গা স্কুলশিক্ষক এবং তার গণহত্যার ডায়েরি (৫ম পর্ব)

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের পঞ্চম পর্ব

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে ফুতুকে নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি; Image Source: Twitter

আরসার (ARSA) ভিডিওটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর নিরাপত্তাবাহিনী আবার দুনসে পাড়ায় ফিরে আসে। তাদের অফিসাররা গ্রামে টহল দিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। একটি দল ফুতুর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। তারা সবাইকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে এবং তাদের পারিবারিক তালিকা বের করার নির্দেশ দেয়। পারিবারিক তালিকা হচ্ছে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একটি সরকারি রেকর্ড। নিরাপত্তাবাহিনী প্রতিটি পরিবারের অনুপস্থিত সদস্যদের নাম তালিকা থেকে কেটে দিচ্ছিল এবং তাদের গ্রামে ফিরে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছিল।

ফুতুদের পরিবারের সবাই তাদের বাড়ির আঙিনায় বেরিয়ে আসে। কেবলমাত্র ফুতুর বড় ভাই বাদে সেখানে সবাই উপস্থিত ছিল। ফুতুর বড় ভাই এক দশকেরও বেশি আগে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ দিয়ে মালয়েশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন, যে পথে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। অফিসারদেরকে প্রথমে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। তারা ফুতুদের সবাইকে ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে নিজেরাও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের কমান্ডার ঘুরে দাঁড়ান এবং ফুতুকে ডাক দেন।

“৯ অক্টোবর আপনি কোথায় ছিলেন?” কমান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন।

ফুতু উত্তর দিলেন, তিনি ছিলেন মিডল স্কুলের ছাত্রাবাসে, তারা ইচ্ছে করলে রাখাইন চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে দেখতে পারে। কমান্ডার তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। এরপর কাছে এসে তার চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “তোরা তাতমাদাওর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিস কেন?” একদলা থুথু ফেললেন তিনি। “কেন তোরা এই সহিংসতা করছিস?”

“আমি কোনো ধরনের সহিংসতায় জড়িত নই।” ফুতু উত্তর দিলেন। “কেন আমি সহিংসতা করব? আপনারা তো আমাদের ভাইয়ের মতো।”

ফুতু বিজিপি অফিসারদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলেন। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় তিনি যে চেকপোস্ট পার হয়ে যেতেন, অফিসারটা সেই চেকপোস্টের দায়িত্বে ছিল। তারা প্রায়ই পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতো। কখনো কখনো একসাথে ফুটবলও খেলতেন। ফুতু মিনতি করলেন, “আমি এই অফিসারকে চিনি। উনিও আমাকে চেনেন। কেন আপনারা আমাদেরকে সন্দেহ করছেন? আমরা একে অন্যকে সাহায্য করি, একে অন্যের উপকার করি। আমি কখনোই এ ধরনের কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম না। আমি একজন শিক্ষক।”

কমান্ডার ফুতুর চুলের মুঠি ধরে রাখলেন। “বাংলাদেশ থেকে আসা লোকেরা কেন পুলিশ আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ফুতু কোনো উত্তর না দিয়ে নিজেকে শান্ত রাখলেন। অবশেষে কমান্ডার তার চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে তাদের অফিসাররা বাড়ির বাইরের চারপাশের বেড়াটি লাথি মেরে ভেঙ্গে দিয়ে গেল।

কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে মায়ানমারের নো ম্যান’স ল্যান্ডে আটকা পড়া রোহিঙ্গারা; Image Source: Ye Aung Thu/AFP/Getty Images

আরসার আক্রমণের পরবর্তী দিনগুলোতে গ্রামের পুরুষদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামের প্রধান আইয়ুবের ভাই ছিলেন মাদ্রাসার একজন শিক্ষক। প্রথমে তাকে মারধর করা হয় এবং এরপর আইয়ুবকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আইয়ুবকে যেদিন আটক করা হয়, সেদিন তার সাথে থাকা দুজন প্রতিনিধি পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান এই আশঙ্কায় যে, তারা হয়তো হবেন পরবর্তী টার্গেট।

কয়েক সপ্তাহ পর একদিন রাখাইন চেয়ারম্যান খবর পাঠান, দুনসে পাড়াসহ আশেপাশের এলাকাগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল আসবে। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারছিল না, তাদের কী আশা করা উচিত। ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর যখন অং সান সু চি দেশের ডি ফ্যাক্টো প্রধান হয়ে উঠেছিলেন, তখন কেউ তার নতুন নেতৃত্বকে পূর্ববর্তী অপরাধের জন্য দায়ী করেনি।

বহু বছর ধরে চলা বর্ণবাদী শাসনের দায় থেকে নারী নেত্রীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন অজুহাত ব্যবহার করে আসছিল। তার মধ্যে এই অজুহাতও ছিল যে, সরকার নয়, বাস্তবে দেশ পরিচালনা করছে তাতমাদাও। কিন্তু আরসার আক্রমণের পর ততমাদাও যখন ‘অঞ্চল মুক্তকরণ কার্যক্রম’ শুরু করে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়।

ফুতু যখন মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি প্রবীণ এবং অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের একটি দলকে দেখতে পেলেন। তারা মাটিতে বসে আলোচনা করছিল, বিদেশিরা এলে তাদের কী করা উচিত। তাদের উপর নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে ইংরেজিতে সাইনবোর্ড তৈরির পক্ষে-বিপক্ষে তারা বিতর্ক করছিল। একজন প্রস্তাব দিলো, তারা ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে “RAPE, GENOCIDE, KILLING, TORTURE” শব্দগুলো লিখতে পারে। আরেকজন বলল, তারা কোনো একজন শিক্ষককে দিয়ে ইংরেজি শব্দগুলোর বানান সঠিকভাবে লিখিয়ে নিতে পারে।

ফুতু ব্যাপারটি সম্পর্কে তার নিজের ধারণা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। ২০১২ সালের দাঙ্গার সময় তাদের গ্রামে এরকম কোনো সমস্যা হয়নি। তারা তাদের রাখাইন প্রতিবেশীদের সাথে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছিলেন। এরকম সময়ে এ ধরনের জিনিস লেখা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

ফুতু নিজেকে কখনো সাহসী মানুষ হিসেবে দাবি করেননি। তিনি কেবল ২০১৩ সালের সাইক্লোনে ধ্বসে পড়া স্কুলটি মেরামতের ব্যাপারেই আগ্রহী ছিলেন। তিনি মাথা নিচু করে রাখলেন, যেন আলাপকারীদের সাথে তার চোখাচোখি না হয়ে যায়। তিনি দ্রুত নামাজ শেষ করে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হাতে বন্দী রোহিঙ্গা মুসলমানরা; Image Source: Reuters

বিদেশিরা এলো ফসল কাটার সময়। ধান গাছের শীর্ষে থাকা চালগুলো তখন শক্ত এবং সোনালি হয়ে এসেছিল। সেগুলো কাটা, মাড়াই করা এবং রোদে শুকানোর উপযোগী হয়ে উঠেছিল। বিদেশিদেরকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি যখন নেমে এলো, ততক্ষণে মাঠের কাজ ফেলে দিয়ে গ্রামের লোকেরা সবাই ধুলোমাখা রাস্তায় এসে জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ প্ল্যাকার্ড ধরে রেখেছিল। কিন্তু অনেকে শুধু বিদেশীদেরকে এক ঝলক দেখার জন্য এমনভাবে ভিড় করছিল, যেন এটা একটা ফুটবল ম্যাচ। একটা সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল, “আর কত দিন আমরা রাখাইন এবং বিজিপি দ্বারা গণহত্যা আর রোহিঙ্গা মা-বোনদের ধর্ষণ সহ্য করব।” ফুতুর মনে হলো, তার ছাত্ররা ফেসবুক থেকে শব্দগুলোর সঠিক ইংরেজি বানান খুঁজে বের করেছে।

বিদেশীদের মধ্যে ছিল কয়েকজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। তারা তাদের নিজেদের দেশীয় পোশাক পরেছিল। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস ছিল, বিদেশিরা আসলেই তাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে। প্রতিনিধিরা সাধারণত তাদের নিজস্ব অনুবাদক নিয়ে আসে, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এই অনুবাদকরা রোহিঙ্গা বলতে পারে না। আবার অন্যদিকে বেশিরভাগ গ্রামবাসী বার্মিজ বলতে পারে না। শেষপর্যন্ত রাখাইন চেয়ারম্যানকে অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো, কিন্তু তিনি উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

সরকারি কর্মকর্তারা ফুতুকে জিজ্ঞেস করল, তিনি সাহায্য করতে পারবেন কি না। আরেকজন শিক্ষকসহ ফুতু সামনে এগিয়ে গেলেন। এক বৃদ্ধ মহিলা অনবরত কেঁদে চলছিল। প্রতিনিধিরা জানতে চাইল, তার সমস্যা কী। মহিলাটি ব্যাখ্যা করল, তার ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে কোথায় আছে, জীবিত না মৃত, তার কোনো ধারণা নেই।

অন্যান্য গ্রামবাসীরাও তাদের পরিস্থিতি বলার চেষ্টা করছিল:

“আমাদের প্রকৃত জাতিসত্তার কোনো স্বীকৃতি নেই। আমাদের কোনোকিছু করার অনুমতি নেই। আমাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার স্বাধীনতা নেই। আমাদের বিয়ে করার জন্য অনুমতি নিতে হয়। আমাদের কোনো ধরনের অধিকার নেই। তারা বলে, আমরা বিদেশি। তারা বলে, আমরা বাঙালি। কিন্তু আমরা বাঙালি না। আমাদের সকল পূর্বপুরুষ, বাবারা, দাদারা দীর্ঘকাল ধরে এখানে বসবাস করে এসেছেন। কেন তারা আমাদেরকে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে না? আপনারা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা দয়া করে এই সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করুন এবং আমাদেরকে স্বীকৃতি দিন।”

পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দলটির সদস্যরা তাদের গাড়ির দিকে ফিরে যেতে শুরু করে, কিন্তু রাখাইন চেয়ারম্যান পেছনে রয়ে যান। গ্রামবাসীদের দিকে ফিরে ক্রুদ্ধস্বরে তিনি বলেন, “তোমরা আমাদের সম্পর্কে অভিযোগ করেছ, আমাদের সরকারকে বিব্রত করেছ। এর জন্য তোমাদেরকে ভুগতে হবে।”

পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব

This article is in Bangla language. It's a translation of the article "The Schoolteacher and the Genocide" by Sarah A. Topol, published in The New York Times Magazine.

Featured Image: New York Times

RB-SM

Related Articles