সুয়েজ খালে এভার গিভেনের ছয় দিন || পর্ব ১

প্রতিদিন মিসরের সুয়েজ খাল দিয়ে অতিক্রম করে গড়ে ৪০-৫০টি জাহাজ। সর্বোচ্চ ১০৬টি জাহাজ অতিক্রম করার অনুমতি আছে। ২০১৯ সালের ২ আগস্ট খালটি দিয়ে ৮১টি জাহাজ অতিক্রম করে রেকর্ড তৈরি করে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত জলপথ এটি।

এ বছরের মার্চে সুয়েজ খালে আটকা পড়ে কন্টেইনারবাহী বিশালাকার জাহাজ এভার গিভেন। আড়াআড়িভাবে আটকে খালের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর পেছনে থাকা জাহাজগুলোও একে অতিক্রম করে যেতে পারে না। দুনিয়াব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় জাহাজটি নিয়ে। টানা ৬ দিন আটকে থাকে এটি। এতে মিসরসহ বিভিন্ন দেশের লোকসান হয় কোটি কোটি ডলার। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে একে নিয়ে ব্যাঙ্গ করা বিভিন্ন মিম। কিন্তু কেন হঠাৎ আটকে যায় এ দানবাকৃতির জাহাজটি? এর পেছনের গল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি বাংলায় অনুবাদ করা হলো।

সুয়েজ খালে আটকে পড়া এভার গিভেন জাহাজ; Image Source: Maxar Technologies

 ক্যাপ্টেন কৃষ্ণান কান্থাভেল লোহিত সাগরের ওপরে ধুলোমলিন কুয়াশার মাঝে ভোরের সূর্য উদয় হতে দেখলেন। মিসরীয় মরুভূমিতে ঘণ্টায় ৪০ মাইলের বেশি বেগে বাতাস আছড়ে পড়ায় আকাশকে হলুদাভ সাদাটে দেখাচ্ছিল। ব্রিজে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টিসীমানা থেকে দেখা যাচ্ছিল আরো ১৯টি জাহাজ সুয়েজ খালে প্রবেশের জন্য তাদের পালা আসার অপেক্ষা করছে।

সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা করা কান্থাভেলের মালবাহী জাহাজটি ছিল ২৩ মার্চ ২০২১ এর ১৩তম জাহাজ। জাহাজের সারিগুলোর মধ্যে তার জাহাজটি ছিল বিশালাকারগুলোর একটি। একইসাথে সবচেয়ে নতুন ও দামী জাহাজও ছিল সেটি। জাহাজের পেছনের দিকে সবুজের মাঝে সাদা রঙে বড় হরফে ইংরেজিতে স্পষ্টভাবে এর নাম লেখা ছিল- এভার গিভেন। সকাল হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট একটি নৌকাতে করে স্থানীয় পাইলটরা আসলো, যারা জাহাজটিকে এর ১২ ঘণ্টার সমুদ্র যাত্রায় দিক নির্দেশনা দেবে।

জাহাজের পেছনের দিকে সবুজের মাঝে সাদা রঙে বড় হরফে ইংরেজিতে স্পষ্টভাবে এর নাম লেখা ছিল- এভার গিভেন;Image Source: AFP

সুয়েজ খাল দিয়ে যাত্রা করা কখনো কখনো স্নায়ুর লড়াই হয়ে ওঠে। এই খাল আফ্রিকা ঘুরে ৩ সপ্তাহ যাত্রা করার সময় বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু এটা খুব সরু, প্রস্থ মাত্র ২০০ মিটার (৬৫৬ ফুট)। আর গভীরতা মাত্র ২৪ মিটার। আধুনিক জাহাজগুলো সে তুলনায় অনেক বিশাল এবং আরো বিশালতর হচ্ছে। এভার গিভেন সামনে থেকে পেছনের দৈর্ঘ্যে ৪০০ মিটার এবং প্রস্থে প্রায় ৬০ মিটার। প্রায় এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের উচ্চতার মতোই এর দৈর্ঘ্য। মালয়েশিয়া থেকে নেদারল্যান্ডের পথে যাত্রায় এটি প্রায় ১৭,৬০০টি কন্টেইনার নিয়ে যাচ্ছিল। জাহাজের তলা থেকে খালের তলদেশের ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক মিটারের। ফলে কোনোপ্রকার ভুল করার সুযোগ বেশি ছিল না।

জাহাজে উঠার পর দুই মিসরীয় পাইলটকে ব্রিজে নিয়ে আসা হলো ক্যাপ্টেন, অফিসার ও কান্ডারীদের সাথে দেখা করানোর জন্য। জাহাজের বাকি ক্রুদের মতো তারাও সবাই ছিলেন ভারতীয়। কয়েক সপ্তাহ পর মিসরীয় এক আদালতে দাখিল করা নথি অনুযায়ী সে সময় তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল- বাজে আবহাওয়ার জন্য তারা আদৌ জাহাজ নিয়ে সুয়েজ খালে প্রবেশ করবে কিনা তা নিয়ে। এই বিতর্ক সম্ভবত আরো উসকে যায় তাদের কারোরই মাতৃভাষা ইংরেজি না হওয়ায় যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটতে থাকায়। ঝড়ের কারণে নিকটবর্তী অন্তত চারটি বন্দর ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। একদিন আগে এক প্রাকৃতিক গ্যাস বহন করা জাহাজের ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নেন দমকা বাতাসের মধ্যে সুয়েজ খাল নিরাপদে পাড়ি দেওয়ার মতো উপযুক্ত নয়। 

বিমানের মতো আধুনিক জাহাজগুলোও সমুদ্রযাত্রার ডেটা রেকর্ডার ব্ল্যাক বক্স ডিভাইস বহন করে, যা জাহাজের ব্রিজে থাকা সবার কথোপকথন রেকর্ড করে। এভার গ্রিনের ব্রিজে পাইলটদের সাথে ক্রুদের পুরো কথোপকথন প্রকাশ করেনি মিসর সরকার। তাই এটা স্পষ্ট নয় তাদের মধ্যে ওই পরিস্থিতি নিয়ে কেমন বাদানুবাদ হয়েছিল।

গোল চিহ্নিত অংশে ক্যাপ্টেন কান্থাভেলসহ এভার গিভেন জাহাজের অন্যান্য ক্রু সদস্যরা; Image Source: The Sun

কিন্তু তামিলনাড়ুর অভিজ্ঞ নাবিক ক্যাপ্টেন কান্থাভেলের ওপর বাণিজ্যিক দিক দিয়ে প্রচুর চাপ ছিল। তার জাহাজ প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য বহন করছিল। এর মধ্যে ছিল আইকিয়া ফার্নিচার, নাইকি স্নিকার্স, লেনোভো ল্যাপটপ এবং ১০০ কন্টেইনার অজ্ঞাত দাহ্য তরল পদার্থ।

এছাড়া আরো কিছু কর্পোরেট চাপ ছিল এভার গিভেনের কন্টেইনারগুলো দ্রুত ইউরোপে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে। এগুলোর মধ্যে ছিল এর মালিকপক্ষ জাপানের এক ধনী পরিবার নিয়ন্ত্রিত শোয়েই কিসেন কাইশা লিমিটেড এবং তাইওয়ানিজ কংলোমারেট কোম্পানি এভারগ্রিন গ্রুপ, যারা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে জাহাজটি পরিচালনা করে আসছিল। অন্যদিকে জাহাজের ক্রুরা কাজ করত জার্মান কোম্পানি বার্নহার্ড শুল্ট শিপ ম্যানেজমেন্টের হয়ে, যারা বাণিজ্যিক জাহাজগুলো পরিচালনা করার জন্য নাবিক সরবরাহ করত। জাহাজ এক দিন বিলম্ব করলে অন্তত দশ হাজার ডলারের বেশি খরচ হতো।

অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনরা বলেন, তাদের প্রায়ই বাধ্য হয়ে খারাপ আবহাওয়া সত্ত্বেও সুয়েজে জাহাজ নিয়ে যেতে হয়। তাদের বলা হয়, “কাজটি করুন। না হলে আমরা অন্য কাউকে নিয়ে নেব যে করতে পারবে।” কিন্তু আধুনিক জাহাজগুলোতে রাডার ও ইলেকট্রনিক সেন্সর থাকে, যা কারিগরি দিক দিয়ে দৃশ্যমান কিছু না থাকলেও খালে জাহাজ পরিচালনা করার সুযোগ দিতে পারে। আর কান্থাভেল সম্পর্কে তার এক সাবেক সহকর্মী বর্ণনা দেন ঠাণ্ডা মাথার আত্মবিশ্বাসী অফিসার হিসেবে, যার সুয়েজ খালে জাহাজ পরিচালনা করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।

ব্রিজ থেকে কান্থাভেল আধ মাইল সামনের অংশ দেখতে পাচ্ছিলেন। উত্তরমুখী অন্যান্য জাহাজের বহর খালের প্রবেশমুখে থাকা বড় ক্রেনকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন তখনও খালে প্রবেশের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারতেন। কিন্তু মিশন চালু রাখতে সকলের আগ্রহ ও জলপথ পরিচালনা করা এজেন্সি থেকে সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর তিনি এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধান মিসরীয় পাইলট রেডিওতে আরবিতে সংক্ষেপে আলোচনা সারলো। তারপর ব্রিজের ক্রুদের জাহাজ এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দিলো। এভার গিভেন তখন বড় সাইনবোর্ড অতিক্রম করে গেল, যাতে লেখা ছিল- ‘মিসরে স্বাগতম’। 

সুয়েজ পাইলটদের নিয়োগ দিয়ে থাকে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ, যারা ১৯৫৬ সালে মিসর সরকার এই খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে এই রুট পরিচালনা করে আসছে। পাইলটরা সাধারণত সাবেক নৌ কর্মকর্তা হয়ে থাকেন। তারা সরাসরি জাহাজ পরিচালনা করেন না। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ক্যাপ্টেন ও কাণ্ডারীদের নির্দেশনা দেওয়া, বহরে থাকা অন্যান্য জাহাজ ও খাল কর্তৃপক্ষের কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করা এবং জাহাজগুলোর নিরাপদে খাল অতিক্রম নিশ্চিত করা।

সুয়েজ খাল অতিক্রম করা জাহাজগুলোর জন্য খাল কর্তৃপক্ষের সম্মুখীন হওয়া বেশ কিছু কারণে দুর্ভোগে পরিণত হয়; Image Source: Egypt State Information Service

কিছু কিছু যাত্রীর জন্য খাল কর্তৃপক্ষের সম্মুখীন হওয়া অনেক দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠে। কাগজে-কলমে সবকিছু ক্যাপ্টেনের অধীনে থাকলেও তাকে ইউনিফর্ম পরা অপরিচিত ব্যক্তিদের কাছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। এদের পেশাদারিত্ব আর পারদর্শিতা ব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্নরকমের হয়ে থাকে।

পাইলটদের পাশাপাশি খাল কর্তৃপক্ষের বিদ্যুৎ মিস্ত্রী, ঘাটের কর্মচারী ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকরাও জাহাজে এসে থাকেন। প্রত্যেকের জন্য কাগজপত্র, খাবার, জায়গা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। তারা অনেক সময় বাক্স ভর্তি সিগারেটও দাবি করে। (খাল কর্তৃপক্ষ পূর্বে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।)

ক্রিস গিলার্ড একজন অফিসার হিসাবে ডেনিশ শিপিং জায়ান্ট ‘এ পি মোলার-মায়েরস্ক এ/এস’ এর হয়ে ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালে প্রতি মাসে একবার করে সুয়েজ খাল অতিক্রম করেছেন। তার কাছে নৌ পরিচালনা ও পাইলটদের নিয়ে কাজ করে খাল অতিক্রম করাটা খুব ভয়ের বিষয় ছিল। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি সুয়েজ পার হওয়ার চেয়ে কোলোনোস্কপি করতেও রাজি আছি।” সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো এর প্রভাব কম নয়। (পরবর্তী অংশ পর্ব ২-এ) 

Related Articles

Exit mobile version