Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বহির্বিশ্বে রুশ সামরিক ঘাঁটি: পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্য আফ্রিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বব্যাপী নিজেদের ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও ভূকৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। এই সামরিক–রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি গড়ে তোলে। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রের উত্তরসূরী রাশিয়া বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক উপস্থিতির মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয় এবং বহু রাষ্ট্রে (যেমন: জার্মানি, পোল্যান্ড, লাতভিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি) অবস্থিত তাদের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়। কার্যত বহির্বিশ্বে নতুন রাশিয়ার যে কয়টি সামরিক ঘাঁটি ছিল, তার প্রায় সবগুলোই ছিল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার অভ্যন্তরে, অর্থাৎ সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে। ১৯৯০–এর দশকে এবং ২০০০–এর দশকের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী রুশ সামরিক উপস্থিতি হ্রাসের এই ধারা অব্যাহত থাকে।

কিন্তু ২০০০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে রাশিয়া পুনরায় বিশ্বব্যাপী তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে নিজেদের সামরিক উপস্থিতির মাত্রা বর্ধিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং এর পাশাপাশি প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার বাইরে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে যেসব প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ডে রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, সেগুলো হলো – আজারবাইজান, আবখাজিয়া, আর্তসাখ, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ ওসেতিয়া, প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে এবং বেলারুশ। এগুলোর মধ্যে প্রথম ৯টি রাষ্ট্রে রুশ সামরিক উপস্থিতি সম্পর্কে ইতিপূর্বের দুইটি নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এই নিবন্ধে বেলারুশে এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার বাইরে রুশ সামরিক উপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

বেলারুশ: ইউনিয়ন রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে রুশ কৌশলগত স্থাপনাসমূহ

পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও পূর্ব স্লাভিক–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র বেলারুশ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং সেখানে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেলারুশ রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। রাশিয়া ও বেলারুশ ‘ইউনিয়ন রাষ্ট্র’ (রুশ: Союзное государство, ‘সয়ুজনোয়ে গোসুদার্স্তভো’; বেলারুশীয়: Саюзная дзяржава, ‘সায়ুজনায়া দজিয়ারঝাভা’) নামক একটি শিথিল কনফেডারেশনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দুইটি ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তদুপরি, বেলারুশ রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেলারুশে রুশ সামরিক উপস্থিতি বজায় রয়েছে। 

আকাশ থেকে গৃহীত চিত্রে বেলারুশে অবস্থিত রুশ স্পেস ফোর্সেস কর্তৃক পরিচালিত হান্তসাভিচি রাডার স্টেশন; Source: Imgur

বর্তমানে বেলারুশে ৩টি রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে – হান্তসাভিচি রাডার স্টেশন, রুশ নৌবাহিনীর ‘৪৩তম যোগাযোগ কেন্দ্র’ এবং বারানোভিচি যৌথ বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। উক্ত ঘাঁটিগুলোর মধ্যে প্রথম দুইটি ঘাঁটি ১৯৯৫ সালে রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সক্রিয় রয়েছে। তৃতীয় ঘাঁটিটি একেবারে নতুন এবং এটি কেবল ২০২১ সালে চালু হয়েছে।

হান্তসাভিচি রাডার স্টেশন বেলারুশের ব্রেস্ত প্রদেশের হান্তসাভিচি শহরের সন্নিকটে অবস্থিত। এটি একটি ‘আর্লি ওয়ার্নিং রাডার’ ঘাঁটি এবং রুশ স্পেস ফোর্সেস এই রাডার স্টেশনটি পরিচালনা করে থাকে। এই ঘাঁটিতে অবস্থিত অত্যাধুনিক রাডারের সাহায্যে রুশরা পশ্চিম ইউরোপ থেকে নিক্ষিপ্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং একই সঙ্গে কিছু কৃত্রিম উপগ্রহের গতিবিধির ওপরেও নজরদারি করতে পারে। ১৯৮২ সালে উক্ত রাডার স্টেশনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়, কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্টেশনটির নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ১৯৯৩ সালে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, রাশিয়াকে লাতভিয়ায় অবস্থিত ‘স্ক্রুন্দা রাডার স্টেশন’ বন্ধ করে দিতে হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে রুশরা হান্তসাভিচিতে রাডার স্টেশন নির্মাণের কাজ পুনরায় আরম্ভ করে। ১৯৯৯ সালে রাডার স্টেশনটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় এবং ২০০৩ সালে স্টেশনটি পূর্ণরূপে সক্রিয় হয়।

রুশ নৌবাহিনীর ‘৪৩তম যোগাযোগ কেন্দ্র’ বেলারুশের মিনস্ক প্রদেশের ভিলেয়কা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত। এই ঘাঁটিতে অবস্থিত ট্রান্সমিটারের সাহায্যে রুশ নৌবাহিনীর জেনারেল স্টাফ আটলান্টিক ও ভারতীয় মহাসাগরদ্বয়ের সম্পূর্ণ অংশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অংশবিশেষে অবস্থানরত রুশ পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। তদুপরি, ইলেক্ট্রনিক রিকনিস্যান্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্যও রুশরা এই ঘাঁটিটিকে ব্যবহার করে। ১৯৫০–এর দশকের শেষদিকে এই ঘাঁটিটির নির্মাণকাজ আরম্ভ হয় এবং ১৯৬৪ সালে ঘাঁটিটি সক্রিয় হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া উক্ত ঘাঁটিটির ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার অধিকার লাভ করে।

আকাশ থেকে গৃহীত চিত্রে বেলারুশে অবস্থিত রুশ নৌবাহিনীর ‘৪৩তম যোগাযোগ কেন্দ্র’; Source: Imgur

বারানোভিচি যৌথ বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বেলারুশের ব্রেস্ত প্রদেশের বারানোভিচি শহরের সন্নিকটে অবস্থিত। ২০২১ সালে বেলারুশীয় বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন বারানোভিচি বিমানঘাঁটিতে উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছে। উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রুশ ও বেলারুশীয় বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে সেখানে রুশ বিমানবাহিনীর কতিপয় ইউনিটকে মোতায়েন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, রুশ ও বেলারুশীয় সরকার রাশিয়ার নিঝনি নভগরোদ ও কালিনিনগ্রাদে অনুরূপ দুইটি যৌথ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে।

সামগ্রিকভাবে বর্তমানে বেলারুশীয় ভূখণ্ডে অন্তত ১,৫০০ রুশ সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বেলারুশে রুশ সামরিক উপস্থিতির মূল উদ্দেশ্য ইউরোপে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন ‘ন্যাটো’ সামরিক জোটের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা। তদুপরি, বেলারুশ ও পূর্ব ইউরোপে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি করা, বেলারুশীয় সরকারের প্রতি নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করা এবং বেলারুশ ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক ও রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের প্রক্রিয়াকে জোরদার করাকেও বেলারুশে রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সিরিয়া: ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর ভরকেন্দ্র

পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত প্রধানত মুসলিম ও আরব–অধ্যুষিত ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র সিরিয়া ১৯৫০–এর দশক থেকে মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচিত। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সিরিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সিরীয় ভূখণ্ডে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও সিরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০১১ সালে সিরীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া সিরীয় সরকারকে ব্যাপক সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে এসেছে। ২০১৫ সালে রাশিয়া সরাসরি এই বহুপাক্ষিক গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে এবং সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সেখানে একটি সৈন্যদল মোতায়েন করেছে।

২০১৮ সালে সিরিয়ায় অবস্থিত হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত একটি প্যারেডের সময় একদল রুশ সৈন্য; Source: Mil.ru via Wikimedia Commons

রাশিয়া সরাসরি সিরীয় যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে। অবশ্য এগুলোর সিংহভাগই স্থায়ী প্রকৃতির নয়, কারণ এগুলো যুদ্ধের প্রয়োজনে স্থাপিত হয়েছে এবং যুদ্ধের অবসান ও সিরীয় পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা আসার পর রুশরা এই ঘাঁটিগুলো বন্ধ করে দেবে। কিন্তু সিরিয়ায় দুইটি স্থায়ী রুশ ঘাঁটি রয়েছে – হিমেইমিম বিমানঘাঁটি এবং তারতুস নৌঘাঁটি। সিরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও উক্ত ঘাঁটি দুইটি বিদ্যমান থাকবে।

হিমেইমিম বিমানঘাঁটি সিরিয়ার লাতাকিয়া প্রদেশের হিমেইমিম গ্রামে অবস্থিত। এটি বর্তমানে সিরিয়ায় রুশ বিমানবাহিনীর সমস্ত কার্যক্রমের ভরকেন্দ্র। সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ বিমানবাহিনীর সিংহভাগ ইউনিটকে উক্ত ঘাঁটিতেই মোতায়েন করা হয়েছে। ২০১৫ সালে রাশিয়া সিরীয় যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করার পর সিরিয়ায় রুশ সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উক্ত বিমানঘাঁটি নির্মিত হয় এবং রাশিয়া ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য উক্ত ঘাঁটিটি ব্যবহারের অধিকার লাভ করে। পরবর্তীতে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া উক্ত ঘাঁটিটি রাশিয়ার নিকট ৪৯ বছরের জন্য ইজারা দিয়েছে। রুশরা কেবল সিরিয়ায় নয়, এতদঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রে (যেমন: লিবিয়ায়) সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্যও উক্ত ঘাঁটিটি ব্যবহার করে থাকে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি রুশরা উক্ত ঘাঁটিতে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী বোমারু বিমানও মোতায়েন করেছে।

তারতুস নৌঘাঁটি সিরিয়ার তারতুস প্রদেশের রাজধানী তারতুস শহরে অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত তারতুস বন্দরে স্থাপিত এই নৌঘাঁটিটি বর্তমানে রাশিয়ার একমাত্র ভূমধ্যসাগরীয় নৌঘাঁটি। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী মস্কো তারতুসে সোভিয়েত ভূমধ্যসাগরীয় নৌবহরের জন্য একটি ‘বস্তুগত–কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র’ স্থাপন করার সুযোগ লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও উক্ত ‘সহায়তা কেন্দ্র’টি বিদ্যমান থাকে। বস্তুত উক্ত ঘাঁটিটির অস্তিত্ব বজায় রাখাকে সিরীয় যুদ্ধে রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৭ সালে রাশিয়া ও সিরিয়ার মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া ৪৯ বছরের জন্য উক্ত ঘাঁটিটিকে রাশিয়ার কাছে ইজারা দিয়েছে। বর্তমানে রাশিয়া উক্ত ঘাঁটিতে সর্বোচ্চ ১১টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করার অধিকার রাখে, এবং সিরিয়া তাদেরকে প্রয়োজনবোধে সেখানে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করার অনুমতি প্রদান করেছে।

আকাশ থেকে গৃহীত চিত্রে সিরিয়ায় অবস্থিত রুশ নৌবাহিনীর তারতুস ঘাঁটি; Source: Digital Globe via The Maritime Executive

এর বাইরে বর্তমানে সিরীয় ভূখণ্ডে বহু সংখ্যক সামরিক ও সামরিক–সংশ্লিষ্ট স্থাপনা রয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে একটি রুশ নৌবহরকে ভূমধ্যসাগরে সিরীয় উপকূলের কাছে স্থায়ীভাবে মোতায়েনকৃত অবস্থায় রাখা হয়েছে; ২০১৬ সাল থেকে হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে রুশ সশস্ত্রবাহিনী ‘সিরীয় আরব প্রজাতন্ত্রে যুদ্ধরত পক্ষসমূহের সমঝোতা ও শরণার্থীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ পরিচালনা করছে এবং ২০১৯ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদলের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছে (ইতিপূর্বে সেটি ছিল হিমেইমিমে)। তদুপরি, যুদ্ধের প্রয়োজনে রুশ সৈন্যরা সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছোট–বড় বহু সংখ্যক ঘাঁটি ও ফাঁড়ি স্থাপন করেছে এবং ২০১৯ সাল থেকে উত্তর–পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডেও বেশ কয়েকটি রুশ ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বর্তমানে সিরীয় ভূখণ্ডে অন্তত ৭,০০০ রুশ সৈন্য মোতায়েন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সিরিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির মূল উদ্দেশ্য সিরীয় যুদ্ধে বিজয় অর্জনে সিরীয় সরকারকে সহায়তা করা। তদুপরি, সিরিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় রুশ প্রভাব বৃদ্ধি করা, ভূমধ্যসাগরে রুশ ভূকৌশলগত অবস্থান শক্তিশালী করা, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে রুশ রাজনৈতিক উপস্থিতির মাত্রা বৃদ্ধি করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান স্নায়ুযুদ্ধে নিজস্ব সামরিক কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করাকেও সিরিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অন্যান্য: অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশে রুশ সামরিক প্রভাব বিস্তার

কার্যত বর্তমানে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূখণ্ডের বাইরে কেবল একটি রাষ্ট্রে রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে সিরিয়া। এর বাইরে অন্য কোনো রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত স্থায়ী রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয় নি। কিন্তু তাই বলে যে প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ড ও সিরিয়ার বাইরে অন্য কোথাও রুশ সামরিক উপস্থিতি একেবারেই নেই, এমন নয়। বস্তুত ২০১০–এর দশকে রাশিয়া সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং তন্মধ্যে প্রণিধানযোগ্য হচ্ছে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ আফ্রিকা। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রুশ সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হয়েছে বা হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

সুদানের পোর্ট সুদান সমুদ্রবন্দরের একাংশের চিত্র। রাশিয়া পোর্ট সুদানে একটি নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য সুদানের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে; Source: Bertramz/Wikimedia Commons

এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উদাহরণ হচ্ছে উত্তর–পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত প্রধানত মুসলিম ও আরব–অধ্যুষিত লোহিত সাগরীয় রাষ্ট্র সুদান। ২০১৯ সালে রাশিয়া ও সুদানের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী রুশ নৌবাহিনী সুদানের সমুদ্রবন্দরগুলো ব্যবহার করার অনুমতি লাভ করে। ২০২০ সালে রাশিয়া ও সুদানের মধ্যে সম্পাদিত আরেকটি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া সুদানের ‘আল–বাহর আল–আহমার’ বা লোহিত সাগরীয় প্রদেশে অবস্থিত পোর্ট সুদান বন্দরে একটি স্থায়ী নৌঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি লাভ করেছে। উক্ত ঘাঁটিটিতে অন্তত ৩০০ রুশ সৈন্য ও ৪টি রুশ যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের সুযোগ থাকবে, এবং প্রয়োজনে রাশিয়া সেখানে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত যুদ্ধজাহাজও মোতায়েন করতে পারবে। কিন্তু ২০২১ সালে সুদানি সরকার চুক্তিটি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। বর্তমানে তারা চুক্তিটির শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা করছে এবং এই বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।

তদুপরি, রুশ মার্সেনারি সংগঠন ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে সক্রিয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ একটি বেসরকারি সংগঠন এবং এটির সঙ্গে রুশ সরকারের কোনো সংশ্রব নেই। কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা, উক্ত সংগঠনটির সঙ্গে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতিকে রাশিয়া সেগুলোতে নিজেদের আনুষ্ঠানিক সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পূর্ববর্তী ধাপ হিসেবে ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে রাশিয়া সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করার আগে থেকেই ওয়াগনার গ্রুপ সেখানে সক্রিয় ছিল।

২০১৭ সাল থেকে ওয়াগনার গ্রুপ মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত খ্রিস্টান–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে সক্রিয়। রাষ্ট্রটিতে ২০১২ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং উক্ত গৃহযুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে। বর্তমানে রাষ্ট্রটিতে অন্তত ১,৫০০ ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য মোতায়েন রয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং তারা রাষ্ট্রটিতে বেশ কয়েকটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে। তদুপরি, ২০১৮ সাল থেকে রাশিয়া মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্রবাহিনীকে সহায়তা করার জন্য রাষ্ট্রটিতে সামরিক প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টা মোতায়েন করতে আরম্ভ করে। প্রাথমিকভাবে এদের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু ২০২০ সালে রাশিয়া মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে অন্তত ৩০০ সৈন্য মোতায়েন করে এবং ২০২১ সালে এই সংখ্যা প্রায় ১,১০০ জনে উন্নীত হয়। বর্তমানে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে রুশ সশস্ত্রবাহিনী এবং ওয়াগনার গ্রুপ উভয়েরই উপস্থিতি রয়েছে।

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে একজন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য এবং একজন মধ্য আফ্রিকান সৈন্য; Source: Associated Press via TRT World

২০১৮ সাল থেকে ওয়াগনার গ্রুপ উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত মুসলিম ও আরব–অধ্যুষিত ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র লিবিয়ায় সক্রিয়। রাষ্ট্রটিতে ২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং উক্ত গৃহযুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা পূর্ব লিবিয়াভিত্তিক লিবীয় আইনসভা কর্তৃক সমর্থিত ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’র (এলএনএ) পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে রাষ্ট্রটিতে অন্তত ১,২০০ ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য মোতায়েন রয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং তারা পূর্ব লিবিয়ায় বেশ কয়েকটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে। রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে লিবিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্রব নেই বলে দাবি করে, কিন্তু ২০২০ সালে রুশ বিমানবাহিনী সরাসরি লিবিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপ ও এলএনএকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। সুতরাং লিবিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রটিতে আনুষ্ঠানিক রুশ সামরিক উপস্থিতিতে রূপ নিতে পারে, এরকম সম্ভাবনা রয়েছে।

২০২১ সালে ওয়াগনার গ্রুপ এবং পশ্চিম আফ্রিকায় অবস্থিত মুসলিম–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র মালির মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং এই চুক্তি অনুযায়ী ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের মালিতে মোতায়েন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রটিতে ২০১২ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং উক্ত গৃহযুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মালিয়ান সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রটিতে অন্তত ১,০০০ ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যকে মোতায়েন করা হবে। উল্লেখ্য, একই সময়ে রাশিয়া ও মালির মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মালিতে ওয়াগনার গ্রুপের সম্ভাব্য প্রবেশকে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা রাষ্ট্রটিতে আনুষ্ঠানিক রুশ সামরিক প্রভাব বিস্তারের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

সামগ্রিকভাবে, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বহির্বিশ্বে রুশ সামরিক উপস্থিতির মাত্রা খুবই সীমিত। বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৮০০টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সেই তুলনায় বহির্বিশ্বে স্থায়ী রুশ সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা নিতান্তই কম। বস্তুত প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ডের বাইরে বর্তমানে খুব কম সংখ্যক রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু বিশেষত ২০১০–এর দশকে রাশিয়া বহির্বিশ্বে নিজেদের সামরিক প্রভাব জোরদার করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ও ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বিশ্বের (বিশেষত আফ্রিকার) বিভিন্ন যুদ্ধকবলিত বা সঙ্কটাপন্ন রাষ্ট্রে নিজেদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। স্বল্প মেয়াদে তাদের এই কৌশল তুলনামূলকভাবে কার্যকর হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই কৌশল মস্কোর জন্য টেকসই হবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।

Related Articles