Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যখন তুরস্ক রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করেছিল || শেষ পর্ব

[৭ম পর্ব পড়ুন]

২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে তুর্কি বিমানবাহিনীর একটি ‘লকহিড মার্টিন এফ–১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’ যুদ্ধবিমান রুশ বিমানবাহিনীর একটি ‘সুখোই সু–২৪এম’ বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করে এবং বিধ্বস্ত বিমানটি থেকে প্যারাশুটের মাধ্যমে অবতরণের সময় রুশ বৈমানিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলেগ পেশকভ তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্ট জোট ‘সুরিয়ে তুর্কমেন ওর্দুসু’র সদস্যদের হাতে নিহত হন। রুশ বিমানটির নেভিগেটর ক্যাপ্টেন কনস্তান্তিন মুরাখতিন আহত অবস্থায় মিলিট্যান্ট–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অবতরণ করতে সক্ষম হন। তাকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে রুশরা একটি ‘মিল মি–৮’ হেলিকপ্টার হারায় এবং উদ্ধারকারী দলের সদস্য নাবিক আলেক্সান্দর পোজিনিচ নিহত হন। পরবর্তীতে ইরানি ‘কুদস ফোর্সে’র অধিনায়ক মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানির তত্ত্বাবধানে এবং রুশ এয়ার, লজিস্টিক্স ও ইন্টেলিজেন্স সাপোর্টের ভিত্তিতে সিরীয় ও হিজবুল্লাহ কমান্ডোরা ক্যাপ্টেন মুরাখতিনকে উদ্ধার করে।

রুশ সরকার এই ঘটনার জন্য তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কিন্তু তুরস্কের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সামরিক প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কার্যত এটি ছিল একটি আবেগবিবর্জিত বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত এবং দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, একটি ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত, কারণ তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা রাশিয়ার জন্য ভূরাজনৈতিকভাবে লাভজনক। কিন্তু রুশ জনসাধারণের একাংশ রুশ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তরুণ জাতীয়তাবাদীরা এটিকে রুশ সরকারের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করছিল এবং সোভিয়েত আমলে বেড়ে ওঠা বয়স্ক রুশ নাগরিকরা মন্তব্য করছিলেন, সোভিয়েত সরকার কখনো এরকম ঘটনার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়তো না।

বস্তুত রুশ সরকারও বিনা প্রতিশোধে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে প্রস্তুত ছিল না। তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনার পর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, তারা যেটা করেছে আমরা সেটা তাদেরকে কেবল একবার মনে করিয়ে দেবো না, এবং এই ব্যাপারে তারা বারবার অনুশোচনা বোধ করবে। এটি ছিল তুরস্কের প্রতি খোলাখুলিভাবে হুমকিসূচক বক্তব্য। পরবর্তী ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, তার হুমকি নেহায়েত অমূলক ছিল না।

রাশিয়ার লিপেৎস্কে অবস্থিত লেফটেন্যান্ট কর্নেল পেশকভের সমাধির ওপরে স্থাপিত স্মারক; Source: Ars.town/IA Regnum

২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর (অর্থাৎ তুর্কিরা রুশ বিমান ভূপাতিত করার পরবর্তী দিন) রুশ বিমানবাহিনী উত্তর–পশ্চিম সিরিয়ায় অবস্থিত মিলিট্যান্ট–নিয়ন্ত্রিত আজাজ শহরে একটি তুর্কি ‘সহায়তা কনভয়ে’র ওপর আক্রমণ চালায়। রুশ বিমান হামলার ফলে কনভয়ের অন্তত ২০টি ট্রাক ধ্বংস হয়ে যায়, এবং ৭ জন ট্রাকচালক নিহত ও অন্তত ১০ জন গুরুতর আহত হয়। কনভয়টি তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কিলিস প্রদেশ থেকে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিল এবং তুর্কিদের ভাষ্যমতে, সেটি সিরীয় মিলিট্যান্টদের জন্য ‘মানবিক সহায়তা’ নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তুর্কি সরকার উক্ত কনভয়ের ওপর পরিচালিত রুশ আক্রমণের বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে।

২০১৬ সালের ১৩ মে ‘পিকেকে’ মিলিট্যান্টরা তুর্কি–ইরাকি সীমান্তবর্তী তুরস্কের হাক্কারি প্রদেশে একটি রুশ–নির্মিত ‘৯কে৩৮ ইগ্লা’ সারফেস–টু–এয়ার মিসাইলের সাহায্যে তুর্কি সেনাবাহিনীর ‘ল্যান্ড ফোর্সেস এয়ার কমান্ডে’র একটি ‘এএইচ–১ডব্লিউ সুপারকোবরা’ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে এবং এর ফলে ২ জন তুর্কি বৈমানিক (ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট বুরাক বিকেবাহশি এবং ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট মুজদাৎ কেরেম শাহান) নিহত হন। তুর্কি সামরিক কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়া পিকেকের কাছে উক্ত ‘ইগ্লা’ ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল। তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ও তুর্কি রাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম যথাক্রমে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তুর্কি হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে। কিন্তু সেসময় তুর্কি সরকার চলমান রুশ–তুর্কি সঙ্কট নিরসনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে গোপন কূটনীতিতে লিপ্ত ছিল এবং এজন্য তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে।

২০১৬ সালের ২৪ জুন প্রায় দুই মাসব্যাপী গোপন কূটনীতির পর এরদোয়ান পুতিনকে একটি চিঠি প্রেরণ করেন এবং রুশ বিমান ভূপাতিতকরণ ও রুশ বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ক্ষমা চান। ২৭ জুন রুশ সরকার এই সংবাদটি ঘোষণা করে এবং রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তী মাসগুলোতে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে অন্তত বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তুরস্কে সংঘটিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর তুর্কি সরকার রুশ বিমান ভূপাতিত করার জন্য ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারীদের (ও পরোক্ষভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে) দায়ী করে এবং তুর্কি সরকারের সমর্থকরা (ও কিছু কিছু রুশ বিশ্লেষক) বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য–উপাত্তের সাহায্যে তুর্কি সরকারের এই দাবিকে সমর্থন করেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, রুশ সরকার তুর্কি সরকারের এই দাবি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ এরপরেও অন্তত তিনবার তুর্কি সৈন্যদের মৃত্যুর জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হয়েছে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুর্কি সৈন্যরা সিরিয়ার আল–বাবে রুশ ‘দুর্ঘটনামূলক’ বিমান হামলায় নিহত তুর্কি সৈন্যদের মৃতদেহ বহন করছে; Source: AP/BBC

২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর (অর্থাৎ তুরস্ক কর্তৃক রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার ঠিক এক বছর পর) সিরিয়ার আল–বাব শহরের উত্তরে তুর্কি ‘ওজেল কুভভেৎলের কোমুতানলি/স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ডে’র সদস্যদের ওপরে পরিচালিত একটি বিমান হামলার ফলে ৪ জন তুর্কি সৈন্য (ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট জাফের এর, সিনিয়র মাস্টার সার্জেন্ট মেলিহ ওজ্জান, পেটি অফিসার এরদাল বোলাত এবং পেটি অফিসার সিনিয়র সার্জেন্ট হালিত তোপুজ) নিহত হন এবং ১০ জন তুর্কি সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। আক্রমণটি কারা পরিচালনা করেছিল, সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী এই আক্রমণের জন্য সিরীয় বিমানবাহিনীকে দায়ী করে, কিন্তু সিরীয় সরকার এই আক্রমণ পরিচালনার দায় অস্বীকার করে। তুর্কি সরকার এই ব্যাপারে আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, কিন্তু তুর্কি প্রচারমাধ্যম এই আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে। রুশ সরকার এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।

২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রুশ বিমানবাহিনীর একটি ‘তুপোলেভ তু–২২এম’ বোমারু বিমান সিরিয়ার আল–বাব শহরে তুর্কি ‘ওজেল কুভভেৎলের কোমুতানলি/স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ডে’র সদস্যদের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং এর ফলে ৩ জন তুর্কি সৈন্য নিহত ও ১১ জন তুর্কি সৈন্য আহত হয়। রুশ সরকার জানায় যে, তারা ‘দুর্ঘটনাবশত’ তুর্কি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, এবং তুর্কি সরকার ও সশস্ত্রবাহিনী রুশদের এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করে। রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানকে ফোন করে তুর্কি সৈন্যদের ‘দুঃখজনক’ মৃত্যুর জন্য ‘শোক’ প্রকাশ করেন, এবং এর মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ বিষয়টির ইতি টানে। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘সিএইচপি’র সভাপতি কেমাল কিলিচদারোলু তুর্কি সৈন্যদের মৃত্যুর জন্য রাশিয়ার কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন, কিন্তু রুশ সরকার তার বক্তব্যকে উপেক্ষা করে।

২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রুশ বিমানবাহিনীর ২টি ‘সুখোই সু–৩৪’ বোমারু বিমান সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বালিউন শহরে তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়নের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। তুর্কি সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, এই আক্রমণের ফলে ৩৪ জন তুর্কি সৈন্য নিহত এবং ৬০ জন তুর্কি সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। কিন্তু তুর্কি সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ৫৫ থেকে ৭০ জন তুর্কি সৈন্য এই আক্রমণে নিহত হয় এবং স্থানীয় সূত্রগুলোর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০০ জন তুর্কি সৈন্য এই আক্রমণের ফলে নিহত হয়। কিন্তু রুশ সরকার এই আক্রমণ পরিচালনার কথা অস্বীকার করে এবং তুর্কি সরকার এই ব্যাপারে রাশিয়াকে দায়ী করা থেকে বিরত থাকে। এর পরিবর্তে তুর্কি সরকার এই আক্রমণের জন্য সিরিয়াকে দায়ী করে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুর্কি সৈন্যরা সিরিয়ার বালিউনে রুশ বিমান হামলায় নিহত তুর্কি সৈন্যদের মৃতদেহ বহন করছে; Source: ASPI Strategist

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে সিরীয় সরকার রুশ, ইরানি ও হিজবুল্লাহ সহযোগিতায় উত্তর সিরিয়ায় অবস্থিত ইদলিব প্রদেশের মিলিট্যান্ট–নিয়ন্ত্রিত অংশ দখল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ইদলিবে তুর্কি ও সিরীয় সৈন্যরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। বালিউনে তুর্কি সৈন্যদের ওপর ধ্বংসাত্মক বিমান হামলার পর তুর্কি সরকার রাশিয়ার পরিবর্তে সিরিয়াকে এই আক্রমণের জন্য দায়ী করে। বস্তুত ইদলিবকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছা তুর্কি সরকারের ছিল না। কিন্তু বিপুল সংখ্যক তুর্কি সৈন্য হতাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তুর্কি জনমতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। এজন্য তুরস্ক ইদলিবে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন স্পিং শিল্ড’ পরিচালনা করে। ২৭ ফেব্রুয়ারির বালিউন বিমান হামলার পর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এই অভিযান চলে।

এসময় তুর্কি ও সিরীয় সশস্ত্রবাহিনী উভয়েই অপর পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে প্রচার করে, এজন্য তাদের প্রদত্ত তথ্য পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। সিরীয় মিলিট্যান্টপন্থী তথ্য সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসে’র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ড’ চলাকালে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর আক্রমণে অন্তত ১৯৭ জন সিরীয় সৈন্য ও মিলিশিয়া, ইরানি সৈন্য ও ইরানি–সমর্থিত মিলিশিয়া এবং হিজবুল্লাহ যোদ্ধা নিহত হয়। তদুপরি, নেদারল্যান্ডসভিত্তিক তদন্তকারী ওয়েবসাইট ‘বেলিংক্যাটে’র কন্ট্রিবিউটর জাকুব জানোভস্কির প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, এসময় তুর্কি আক্রমণের ফলে অন্তত ৫৮টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। একই সময়ে তুর্কি বিমানবাহিনী সিরীয় বিমানবাহিনীর ২টি ‘সু–২৪এম২’ ও ১টি ‘অ্যারো এল–৩৯ অ্যালবাট্রস’ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে, কিন্তু বিমানগুলোর বৈমানিকরা প্রাণে বেঁচে যান। অন্যদিকে, ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ড’ চলাকালে সিরীয় সশস্ত্রবাহিনীর আক্রমণে অন্তত ৮ জন তুর্কি সৈন্য নিহত ও অন্তত ২২ জন তুর্কি সৈন্য আহত হয়, এবং সিরীয় সৈন্যরা অন্তত ৪টি তুর্কি ড্রোন ভূপাতিত করে।

এভাবে বালিউনে তুর্কি সৈন্যদের ওপর বিধ্বংসী রুশ বিমান হামলার প্রত্যুত্তরে তুর্কিরা সিরীয়দের বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি ধ্বংসাত্মক অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু তুর্কিদের তুলনায় সিরীয়দের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুলাংশে (অন্তত ২০ গুণ) বেশি হলেও তুর্কিরা ও তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত মিলিট্যান্টরা ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ডে’র আগে সিরীয়দের অধিকৃত ভূমি নিজেদের দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। তীব্র যুদ্ধের পর সিরীয় সৈন্যরা তুর্কি সৈন্য ও তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত মিলিট্যান্টদের কাছ থেকে সারাকিব ও এম–৫ হাইওয়ে পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, তুর্কিদের ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ড’ চলাকালে রুশরা সিরীয়দের সহায়তা করছিল, কিন্তু তুর্কিরা কোনো রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকে।

২০২০ সালের মে মাসে ইদলিবে একটি যৌথ টহলের সময় রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা; Source: Anadolu Agency/Daily Sabah

৫ মার্চ এরদোয়ান মস্কো সফর করেন এবং পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তারা ইদলিবে যুদ্ধবিরতি স্থাপন করতে সম্মত হন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, এম–৪ হাইওয়ের ৬ কি.মি. উত্তর ও ৬ কি.মি. দক্ষিণে একটি ‘নিরাপত্তা করিডোর’ স্থাপিত হয় এবং রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা সেখানে যৌথ টহল পরিচালনা করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত সিরীয়রা ইদলিবের যেসব অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলোর কোনোটি থেকে তাদেরকে পশ্চাৎপসরণ করানোর ব্যাপারে তুর্কিরা রুশদের রাজি করাতে পারেনি। ইদলিবে শরণার্থীদের জন্য ‘সেফ জোন’ সৃষ্টির তুর্কি প্রস্তাবও রুশরা প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে ‘অপারেশন স্প্রিং ফিল্ড’ চলাকালে তুর্কিদের তুলনায় সিরীয়রা বেশি সামরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়।

বালিউনে তুর্কি সৈন্যদের ওপর রুশ বিমান হামলার পর তুর্কিরা রুশদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে রুশদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকে এবং এর পরিবর্তে রুশদের প্রক্সি সিরীয়দের ওপর আক্রমণ চালায়। রুশরাও তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে আগ্রহী ছিল এবং এজন্য ‘অপারেশন স্প্রিং ফিল্ড’ চলাকালে তারা সিরীয়দের সহায়তা করে, কিন্তু তুর্কিদের ওপর নতুন কোনো আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। অবশ্য নিজেদের প্রক্সিদের ওপর তুর্কিদের এত তীব্র আক্রমণে তারা যে খুশি হয়নি, সেটি বলাই বাহুল্য।

২০২০ সালের ২৬ অক্টোবর রুশ বিমানবাহিনী সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের কাফর তাখারিম শহরে অবস্থিত ‘ফায়লাক আল–শাম’ মিলিট্যান্ট জোটের একটি ঘাঁটির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে ৭৯ থেকে ১০৫ জন মিলিট্যান্ট নিহত হয় এবং ১০০ জনের বেশি সংখ্যক মিলিট্যান্ট আহত হয়। ‘ফায়লাক আল–শাম’ মূলত তুরস্কের প্রক্সি হিসেবে বিবেচিত এবং তাদের ওপর পরিচালিত রুশ আক্রমণ ছিল ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ডে’র সময় রুশ প্রক্সিদের ওপর তুর্কিদের আক্রমণের জবাব। তদুপরি, এসময় তুরস্ক বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে, বিশেষত লিবিয়ায় ও আজারবাইজানে, তাদের সিরীয় প্রক্সিদের মার্সেনারি হিসেবে ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিল এবং ‘ফায়লাক আল–শামে’র ওপর রুশ আক্রমণ ছিল তুর্কিদের প্রতি এই বিষয়ে একটি সূক্ষ্ম সতর্কবার্তা।

২০২০ সালের অক্টোবরে সিরিয়ার ইদলিবে রুশ বিমান হামলায় নিহত কিছু তুর্কি–সমর্থিত ‘ফায়লাক আল–শাম’ মিলিট্যান্টের মৃতদেহ; Source: Mohammed Al-Rifai/AFP/Getty Images via The New York Times

কিন্তু এসময় নাগর্নো–কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছিল এবং এই যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছিল। এজন্য সিরিয়ায় তুর্কি প্রক্সিদের ওপর রুশ আক্রমণের জবাব দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ২৮ অক্টোবর তুর্কি আইনসভায় প্রদত্ত একটি ভাষণে এরদোয়ান ‘ফায়লাক আল–শামে’র ওপর রুশ আক্রমণের নিন্দা জানান, কিন্তু এর বাইরে তুরস্ক এই বিষয়ে অন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

এভাবে ২০১৫ সালে রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পর থেকে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে একটি অলিখিত নিয়ম জারি রয়েছে। তুর্কিরা রুশ প্রক্সিদের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু রুশ লক্ষ্যবস্তুর ওপর সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে, রুশরা তুর্কি প্রক্সিদের ওপর আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি সময়ে সময়ে তুর্কি লক্ষ্যবস্তুর ওপর সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করা অব্যাহত রেখেছে।

কিন্তু রুশদের তুর্কি লক্ষ্যবস্তুর ওপর সরাসরি আক্রমণ পরিচালনার ব্যাপারে রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়েই আপাতদৃষ্টিতে এক অদ্ভুত নীতি অনুসরণ করে চলেছে। ২০১৬ সালের মে মাসে পিকেকে কর্তৃক রুশদের সরবরাহকৃত ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে তুর্কি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করা এবং নভেম্বরে আল–বাবের কাছে তুর্কি সৈন্যদের ওপর পরিচালিত বিমান হামলার ব্যাপারে রুশ সরকার মৌনতা বজায় রেখেছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল–বাবে তুর্কি সৈন্যদের ওপরে পরিচালিত বিমান হামলাকে রুশরা ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সবশেষে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বালিউনে তুর্কি সৈন্যদের ওপরে পরিচালিত বিমান হামলায় জড়িত থাকার কথা রুশ সরকার সরাসরি অস্বীকার করেছে।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে আজারবাইজানের আগদামে নাগর্নো–কারাবাখে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপিত ‘রুশ–তুর্কি যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আজারবাইজানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাকির হাসানভ (কেন্দ্রে) এবং একজন রুশ ও একজন তুর্কি কর্মকর্তা কেক কাটছেন; Source: Azerbaijani Ministry of Defense

অন্যদিকে, এই ব্যাপারে তুর্কি সরকারের প্রতিক্রিয়াও রুশদের মতোই অবিমিশ্র। ২০১৬ সালের মে মাসে তুর্কি সরকার তুর্কি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার জন্য রাশিয়াকে পরোক্ষভাবে দায়ী করে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে আল–বাবে তুর্কি সৈন্যদের ওপরে পরিচালিত বিমান হামলার জন্য তুর্কি সরকার রাশিয়ার পরিবর্তে সিরিয়াকে দায়ী করে (কিন্তু সিরিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে)। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল–বাবে তুর্কি সৈন্যদের ওপরে পরিচালিত রুশ বিমান হামলা সম্পর্কে রুশ সরকারের প্রদত্ত ব্যাখ্যা তুর্কি সরকার গ্রহণ করে এবং কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বালিউনে তুর্কি সৈন্যদের ওপরে পরিচালিত বিমান হামলার পর তুর্কি সরকার আবারো রুশ সরকারের প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে এবং এই বিমান হামলার জন্য সিরিয়াকে দায়ী করে।

অর্থাৎ, রাশিয়া ও তুরস্ক একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনমাফিক স্বার্থের সংঘাত চালিয়ে যেতে আগ্রহী। এর ফলে একদিকে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, আবার অন্যদিকে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও চলছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে (প্রধানত সিরিয়ায়) রাশিয়া ও রুশ প্রক্সিদের সঙ্গে তুরস্ক ও তুর্কি প্রক্সিদের সংঘর্ষও অব্যাহত রয়েছে। এসবের থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর থেকে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে একইসঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার একটি নতুন প্যাটার্ন সৃষ্টি হয়েছে। রুশ–তুর্কি সম্পর্কের বর্তমান গতিপ্রকৃতির প্রেক্ষাপটে ধারণা করা যায় যে, তাদের সম্পর্কের এই প্যাটার্ন নিকট ভবিষ্যতে বিশেষ পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু এই প্যাটার্ন প্রকৃতপক্ষে মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, এবং উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর অনুরূপ কোনো একটি ঘটনা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ রুশ–তুর্কি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

Related Articles