Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাচিকো: পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল যে মেয়েটি (পর্ব – ১৫)

ফাদার

১৯৫৫ – ১৯৬১

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৫ সালে নাগাসাকির পিস পার্কে বিশালাকার এক ব্রোঞ্জের মূর্তি উন্মোচন করা হয়। জায়গাটি ছিল বিষ্ফোরণস্থলের কাছাকাছিই। মধ্যবয়স্ক পুরুষের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা সেই মূর্তির বাম হাত আনুভূমিকভাবে রাখা ছিল, যা চিরঅধরা, অনন্তকাল স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশার প্রতি ইঙ্গিত করে। আর ডান হাতটি তর্জনী দিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করে পারমাণবিক বোমা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অস্ত্র প্রতিযোগিতার ভয়াবহতার কথাই জানান দিচ্ছিলো।

Image Source: Japan Guide

প্রতিদিনই আকাশের দিকে তাকিয়ে আকি, ইচিরো, মিসা, তোশি আর মামার কথা ভাবতো সাচিকো। তার সাথে একদিনের কথোপকথনে বাবা একদিন বলেছিলেন, “মা রে, দুনিয়াতে কোনো প্রাণই অনর্থক কিংবা অপচয়ের জন্য না। তোমার জীবনটাকে পরের জন্য বিলিয়ে দিও। মনে রেখ, প্রতিটা জীবনই মহামূল্যবান।

সেই সাথে বাবা আরও বলেছিলেন, “কেবলমাত্র সামনের দিকেই তাকাবে। কোনোভাবেই থেমে গেলে চলবে না। কেবলমাত্র তাহলেই তুমি আশার আলোর সন্ধান পাবে।

সাচিকো তার সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করলো। পেছনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে নাগাসাকির একটি বড় কোম্পানিতে ভালো বেতনের একাউন্টেন্ট পদে চাকরিও হয়ে যায় তার। বাবা তখনও ব্যাংকে চাকরি করছিলেন। চাকরি করছিল সাচিকোও। ফলে সামনের দিনগুলো ভালোই যাবে বলে মনে হচ্ছিলো।

হিরোশিমা অ্যাটমিক ডোম: হিরোশিমায় বোমা হামলার কাছাকাছি স্থাপনাগুলোর মাঝে কেবলমাত্র এই ভবনটিই রক্ষা পেয়েছিল; Image Source: Atomic Heritage Foundation 

আঠারো বছর বয়সে সাচিকো অতীতের দিনগুলো সম্পর্কে কোনোরকম কথাবার্তা বলাই বন্ধ করে দিলো। সে ভেবেছিলো, অতীতের দিনগুলো সম্পর্কে কোনোকিছু না বললেই সেসব দিনের দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া দেবে না। উঁচু হিলের জুতা পায়ে গলিয়ে, স্টাইলিশ স্কার্ট ও ব্লাউজ পরে, মাথায় হ্যাট দিয়ে নতুন করে গড়ে ওঠা সব ভবন ও সড়ক পেরিয়ে যেত সে। তাকে দেখে বোঝার উপায়ই ছিলো না যে, ছয় বছর বয়সে এই সাচিকোই বোমা হামলার পর ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে কাতরাচ্ছিলো। তাকে দেখে বোঝার ছিলো না যে, সে একজন ‘হিবাকুশা’।

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হবার পরেও যারা বেঁচে ছিল, তাদেরকে বলা হয় হিবাকুশা, সোজা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘যে মানুষগুলো বোমা হামলার শিকার হয়েছে’। হিবাকুশা হতে হলে একজন ব্যক্তিকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হতো।

১) সরাসরি পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হয়েও বেঁচে গিয়েছেন, বা

২) বিষ্ফোরণস্থলের ২-৩ মাইল (৩.২-৪.৮ কিলোমিটার) দূরে অবস্থান করছিলেন এবং বিকিরণের শিকার হয়েছিলেন, বা

৩) পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ২ সপ্তাহের মাঝে হিরোশিমা কিংবা নাগাসাকি গিয়েছেন, যার ফলে তিনিও বিকিরণের শিকার হয়েছেন, বা

৪) পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়ার কিছুদিনের মাঝেই যেসব মা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন, তাদের সন্তানরাও ছিলো এর অন্তর্ভুক্ত।

বাবা, মা, সাচিকো এবং অন্য সকল হিবাকুশাকেই বাকিটা জীবন পারমাণবিক বোমা হামলার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়েছে।

সুতোমু ইয়ামাগুচি একজন বিশেষ হিবাকুশা, যিনি দুটো পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সময়ই দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; Image Source: Wikimedia Commons

বিষ্ফোরণের ফলে দেহের পোড়া জায়গাগুলোতে তৈরি হওয়া পুরু কেলয়েডগুলোকে হিবাকুশারা ফুল-হাতা শার্ট বা সোয়েটারের মাধ্যমে ঢেকে রাখতো। যাদের মাথার চুল গজানোর আর কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না, তারা জনসমক্ষে টুপি পরেই ঘুরে বেড়াতো।

সুস্থ যুবকরা হিবাকুশা যুবতীদের সাথে সংসার করতে ভয় পেত। একইভাবে সুস্থ যুবতীরাও ভয় পেত হিবাকুশা যুবকদের জীবনসঙ্গী করার কথা ভাবতে। বোমা হামলার দিনটির কথা সবাই মনে রেখেছিল। ফলে তারা ভয় পেত, তাদের সন্তানরাও এই হামলার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়েই জন্ম নেবে কি না সেটা ভেবে।

কেউই আসলে তাদের এসব দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তার কথা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে চাইতো না, জানাতো চাইতো না বিকিরণের ফলে তাদের অসুস্থতার ব্যাপারে। বাবাও ছিলেন এই দলেরই মানুষ। তিনিও একেবারেই চুপ হয়ে গিয়েছিলেন এসব ব্যাপারে।

ক্লান্তি তাকে কাবু করে ফেলেছিল, তবে তিনি সেই ব্যাপারে কারো সাথেই আলাপ করেননি। কিন্তু মা ঠিকই বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন। বাবার ওজন কমে যাচ্ছিলো। তার চামড়া হলুদাভ বর্ণ ধারণ করেছিল। সবকিছুর প্রতিই তার কেমন যেন বিতৃষ্ণাবোধ কাজ করতো, জ্বর লেগে থাকতো প্রায়ই। পাবলিক বাথে গিয়ে শরীর ভিজিয়ে আসার পরামর্শ দিতেন মা, যাতে করে বাবা কিছুটা শান্তি পান। কিন্তু বাবার শরীরে যেন ঐ পর্যন্ত যাবারও শক্তি কুলোতো না।

তাহলে মাদুরে শুয়ে বিশ্রাম নাও,” এটুকু বলেই বাবাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে শুরু করে দিতেন মা।

বাবা ভাবতেন, কর্পূর গাছগুলোর ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিলে হয়তো তার কিছুটা ভালো লাগতে পারে। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে, সেই গাছগুলোর ওখানে যাওয়ার শক্তিটুকুও তার দেহে আর অবশিষ্ট ছিলো না। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, আর কিছুই করতে পারছিলেন না। তার শরীরটা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিলো।

সাচিকোর বাবা-মায়ের একটি দুর্লভ ছবি। ১৯৫০ সালের কাছাকাছি কোনো একসময় তোলা হয়েছিল এটি; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

পরিস্থিতি সুবিধার না আঁচ করতে পেরে সাচিকো আর মা তাকে দ্রুতই নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। দায়িত্বে থাকা ডাক্তার তাকে বেশ ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন।

বাবার লিভার ক্যান্সার হয়েছিল! পারমাণবিক বোমা হামলার ফলে সৃষ্ট বিকিরণেই এই সর্বনাশ হয় তার।

না, আর যারই হোক, অন্তত বাবার না!” ফিসফিস করে বলে উঠলো সাচিকো। তাকে ছাড়া সে কীভাবে বাঁচবে? বাবাকে হারানো আর নিজের দুটো হাত হারানো সাচিকোর কাছে সমার্থক বিষয় ছিলো। তাকে ছাড়া সে বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে?

বাবার ক্যান্সারটা বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল। কিছুদিনের মাঝেই তিনি পুরোপুরি কোমায় চলে গেলেন। দিনের পর দিন মা আর সাচিকো হাসপাতালে বাবার বিছানার সামনে নির্ঘুম সময় পার করতে লাগলো। হাতে হাত রেখে মা-মেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতো বাবার রোগমুক্তির জন্য, অপেক্ষা করতো কবে তিনি সুস্থ হয়ে আবারও তাদের মাঝে ফিরে আসবেন সেই দিনটির জন্য; ওদিকে হাসপাতালের বিছানায় অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন বাবা।

এর মাত্র বারো দিন পর, ১৯৬১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, জীবনের বাকিটা সময় কীভাবে চলতে হবে সে ব্যাপারে সাচিকোকে কোনো নির্দেশনা না দিয়েই বাবা চিরতরে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমালেন। মা কেবল সাচিকোর দিকে ফিরে বলেছিলেন, “এখন তোমাকেই তোমার বাবার জায়গা নিতে হবে মা।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) পর্ব – ১  ||  ২) পর্ব – ২  ||  ৩) পর্ব – ৩  ||  ৪) পর্ব – ৪  ||  ৫) পর্ব – ৫  ||  ৬) পর্ব – ৬  ||  ৭) পর্ব ৭ ||  ৮) পর্ব ৮  ||  ৯) পর্ব ৯  ||  পর্ব ১০  ||  পর্ব ১১  ||  পর্ব ১২  ||  পর্ব ১৩  ||  পর্ব ১৪ 

This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.

Reference Book

1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Feature Image: The Independent

Related Articles